এই যে দেখছি

বহু বহু দিন আগে এই ব্লগের নাম  ছিল ' এই যে দেখছি '। সে আমার স্কুল সময়ের কথা। বাংলা মিডিয়ামের ভগবানের নাম ছিল সুমন চট্টোপাধ্যায় । ঐ ভিন্ন  গান নাই,ঐ ভিন্ন বুলি নাই। রবীন্দ্রনাথ তখন বড্ড দূরের  লোক। গান বলতে সুমন । আর উচ্চারণেও সুবিধা না? যুক্ত অক্ষরের বদলে দুই সিলেবল্ নাম।

কী আশ্চর্যের কথা ! এতক্ষণ যা  লিখছি সবকিছুই কেমন শব্দ কেন্দ্রিক। না না word নয়, sound।গান মানেই তো সাউণ্ড। নাম উচ্চারণেও শব্দ ।গানের সুরেও শব্দ। গান শুনে, কী মনোমত কথা 'শুনে' আহা হা হা  বলে কেঁদে ওঠা তো শব্দ! এতো এতো শব্দ ছড়িয়ে থাকে জীবনে,খেয়াল করি?
করিনা তো ।
কেমন হয় শব্দহীনের জগৎ? যেখানে সবার ঠোঁট নড়ছে,  অথচ কিছুই শোনা যাচ্ছেনা ।দিন  থেকে রাত হচ্ছে ,টের পাওয়া  যায় আলোর কমা বাড়ায়। হাওয়া জল সবই তখন প্রকৃতি নির্দেশক। অনুভূতি বিষয়ক। কেমন সে জগতের রূপ? যেখানে সম্পর্কেরা অবয়ব মাত্র। আঙ্গিকে ভাষা ফুটে ওঠে। হাতে পায়ের ডোলেে ডাক নাম রাখা থাকে। এ এক অদ্ভুত জিনিস, এই ডাকনাম। ভালো নাম তো সার্বজনীন। খাতায়-কলমে বন্দী। ওতে প্রাণ নেই। ডাকনামে দূরত্ব কমে পাশবালিশের নৈকট্য নিয়ে আসে। প্রতি ডাকে, যে ডাকছে তার ঠোঁটের ফাঁক করার ধরণ, চকিতে ডাকের ভঙ্গি, কিংবা  অনর্থক চোখ ঘোরানো এমন কত তুচ্ছ-মধুর ছাপ। সেই ডাকের সুরের তারতম্যে রাগ অভিমান কী নেহাত আবদার-সব আলাদা চেনা চেনা যায়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় আওয়াজ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, না? মানুষকে চেনা মানে যে তার শরীরের নানা শব্দও চেনা, তা বুঝে উঠতে উঠতে বড় বেশী সময় লাগে আমাদের। এই যেমন পায়ের আওয়াজ। গোড়ালি ঘষার তারতম্য চিনে যাই আমরা। কিংবা কড়া নাড়ার ঝোঁক। বাড়ির মানুষেরা কেমন একবার বা একাধিকবারের তাল সম্ চিনে রাখেন জাদুর মতন। বলে দেন নির্ভুল,  ঐ অমুকে এলো। এই এত এত শব্দের দৈনন্দিন যাপন থেকে দূরে, এক্কেবারে দূরেে যে তার তাহলে কী হয়? তার পৃথিবীতে রূপ রস বর্ণ গন্ধ থাকে। থাকে স্বাদও। কন্ঠ নেই। সুর নেই। অনেক তীব্র গ্রামের শব্দ উচ্চৈস্বরে বাজতে বাজতে তার কাছে পৌঁছয় একখানা ময়লা ফিনফিনে আওয়াজের মতন। তবে সেসব অচিনপুর।
এসব কথা আমরা ভাবিই না কখনও। আমরা, যারা শব্দবিহীন নই। অর্থাৎ কাঁচা বাংলায় "কানে কালা" নই। তারা আসলে জানিইনা প্রকৃতির আমাদের "সব দেওয়া" - র অর্থ কী.. শরীরের প্রতিটি অঙ্গ সচল সুস্হ ভাবে কাজ করার মূল্য কী। যে হারায় সে জানে এক। আমরা জানিইনা। তাই কানে না শোনা মানুষের খবরও রাখিনা আমরা কখনও।
এখন গোটা পৃথিবী বাধ্য হয়ে শব্দহীন। আমাদের এই সাত পুরোনো বাড়ির চারপাশের আওয়াজের মধ্যে চড়ুই, বুলবুলি, দোয়েল কোকিলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আর গৃহস্থ শব্দ। আমাদের বাড়িতে যে মানুষটা আজ এতগুলি বছর এক ডাকে সমস্ত নৈশঃব্দ ভাঙতেন, তিনি পুট করে পালালেন এই সময়টাই বেছে। রাশি রাশি পাতা ওড়া রাজবল্লভপাড়া ডিঙিয়ে, হু হু করা মদনমোহনতলা স্ট্রিট পেরিয়ে, পোড়ো ঘাটের মতন দেখতে লাগা কাশীমিত্তিরে। আধঘন্টা আগেও বেঁচে ছিলেন যিনি, নিঃশব্দে চলে গেলেন। সেদিন শ্মশানেও শব্দ ছিল না। হাওয়ার শব্দ ছিল বটে। তবে ঐ শব্দ কী আর আলাদা? আর ছিল একের পর এক মৃতদেহ বহনকারী গাড়ির শব্দ। অবাক হয়ে দেখছিলাম গৃহবন্দী দেশকে কলা দেখিয়ে একমাত্র মৃত্যু হৈ হৈ করে পেরিয়ে আসছে রাস্তা। আমার ছোড়দাদু, এ পরিবারের শেষ অভিভাবক, খুব নৈঃশব্দের মধ্যে মরে গেল। আমরা কাঁদতেও পারিনি শব্দ করে। এত দূরে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম সবাই। ফোঁপানোর আওয়াজ পাওয়া সম্ভব হয় না দূরত্বে।
আজকাল যত বয়েস বাড়ছে, যত প্রেমের গান সবই যেন পুজো, আর পুজোর গানে আদর মনে হয় । প্রেম পাল্টায় বোধহয় বয়েস বাড়লে। পরিবারের সাথে প্রেম হয়। সম্পর্কের সাথে প্রেম হয়। ভগবানের সাথেও। গত কদিন সমানে ভাবনার সাথে একখানা গান মনের মধ্যে বাজছে খালি "জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে?" আমি শুনতে পাই এখনও। আমাকে ডাকার আর কেউ নেই শুধু। আমিও তোমার দলে ছোদ্দাদু। আমি রইলাম। "ভয় করিনি"। আমি রয়ে গেলাম তোমার পরে। 

Comments

Popular Posts