বিবিজানের প্রত্যাবর্তন

                                                   "তরী খানি ভাসিয়ে দিলাম ঐ কূলে,
                                               ওগো, যখন তুমি এলে আবার সব ভুলে।"




শ্যামল মিত্রের গানখানি নিখাদ প্রেমের গান।মধুর বিষাদ ছুঁয়ে আছে গানের কথায়, সুরে,পিছনে বেজে ওঠা পিয়ানোর আওয়াজে।সর্বত্র।গানটা শুধু প্রেমের গান হয়ে ছিল এত দিন।আর যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ছিল,তা হল শ্যামল মিত্রের গলার জাদু। সুমন প্রথম গানটায় বেশী করে আলো ফেললেন অন স্টেজ।তাঁর নিজের গান "খোদার কসম জান" গাইতে গাইতে।অবশ্যই আমি পুরোনো লেখা গানটার কথা বলছি,যার কথায় ছিল "পাশের বাড়ির মেয়ে, তার মুখে তোমাকেই জান / খুঁজে খুঁজে কত গেয়েছি,শ্যামল মিত্তিরের গান / কী করে গাইত ভাবি,মানুষটা অমন গলায়?" বলেই গেয়ে ওঠেন "তরীখানি ভাসিয়ে দিলাম " ......ভিডিওটি এখনও ইউ টিউবে আছে।দেখলেই এবং শুনলেই চমকে উঠি।আসলে পাশের বাড়ির মেয়ে...এর মধ্যে তিনটি শব্দই চিরচেনা।তার সাথে শ্যামল মিত্রের গান।এই সংযোগ উত্তর কোলকাতার প্রাচীন গন্ধ এনে দেয় আর কী আশ্চর্য! আমি সেই কথাই লিখতে বসেছি।
সব ছেড়ে এবার এক অন্য রকম ঘরে ফেরা হল। এই ফেরার মূল্য বোধ হয় ১৯৯০ সালের ২৩শে জানুয়ারীর সাথে মেলে।মায়ের কাছে শুনেছি,জন্মানোর দশ দিন বাদে ওই দিন আমি হাসপাতাল থেকে ১৫ নং লক্ষী দত্ত লেন,কলকাতা-৭০০ ০০৩ এ ঢুকি। এখন এই সাতাশ বছর ধরে নাগালের মধ্যের আর তার একটু বাইরের গোটা চৌহদ্দি চষে আমি বাড়ি ফিরেছি সবে কটা মাত্র দিন হল। শুনে মনে হচ্ছে তো যে বাড়ি ছেড়ে দূরে ছিলাম? আদৌ নয়।এই বাড়িতেই আছি জ্ঞান হওয়া ইস্তক।কিন্ত হুট করে আমার বাড়ি ছিল না বেশ কিছু সময়।এর কারণের গোড়ায় গলদ।আবার গলদও কী? ওভাবে বলা যায়না বোধ হয়।
আসলে যৌথ পরিবার বেশী দিন একটানা থাকলে কিছু নিয়ম শুধু পারম্পরিক নিয়মের মত কাগুজে হয়ে যায়। যৌথ পরিবার মানেই হাঁড়ির মাপ বড়ো।ভাবনার অভিমুখ সব সময় বেশী সংখ্যকের জন্য।কিন্ত ছোট তিন খানা পাকা ইঁটের ভিত্তিতে গোটা পাঁচিলের মৌচাক গড়ে ওঠে,এই শিক্ষা যদি ঈশ্বর দিতে দেরী করেন,তবে নিজেদের ভুলগুলোকে ঠাকুর ভেবে পূজো করে সে শিক্ষা নেওয়া দরকার।তাতে এই স্বস্তি থাকে যে এই প্রাথমিক থেকে যে বিশাল আকার তৈরী হবে,যার পারিভাষিক নাম হবে "পরিবার"- তার ভিত্তি দৃঢ় হবে।অনেক ছেলে- পুলের ভিড়ে, বিত্তে নিম্ন-শৌখিনতায় ক্লাসিক, এক পরিবারের  দৈনন্দিনতা বজায় রাখার যুদ্ধে,সবাই...অন্তত বেশীর ভাগই ভুলে গেছিল বাকিদের এই আদিম,অথচ প্রাথমিক শিক্ষার কথা মনে করিয়ে যেতে।ঐ প্রথম তিনটে ইঁটের গাঁথুনির কথা।যারা ভূমি ছুঁয়ে থাকে,যে ছুঁইয়ে থাকার একেবারে শেষে ছাত।আকাশ দেখার জায়গা।

আমি যে ছিলাম না বাড়িতে তার কারণ বাড়ি,পাড়া,এলাকা,শহর,রাজ্য আর দেশটাই অচেনা হয়ে গেছে। যেখানে বসে লিখছি সেখানে লোহার জালের জানালা, ৫০ সালের। কালো কাঠের পাল্লা।বাইরে টুকটুকে  লাল আকাশ।বৃষ্টি হচ্ছে।ভরা আষাঢ় মাস।সামনে যে বাড়িটা তার দেওয়ালে নোনাই আছে শুধু।তাই অন্ধকারে আরো কালো লাগে।দূরের  ছাতটার কানায় চ্যাপ্টা টবের আগাছা এই লাল আকাশের গায়ে দিব্যি দেখা যাচ্ছে।আরো কিছু রেলিঙের কারুকাজ...এসব আমি চিনি।কবে থেকে তার ঠিক ঠিকানা নেই।আজন্ম,জন্ম-জন্মান্তরের চেনা।
কিন্তু এই চেনাগুলো বেশ কিছু দিন হল শুধু আকৃতিগত পরিচয়ে এসে ঠেকেছিল।এই যে বাড়িগুলো নাম পেল যাদের নামে,এই বাড়িগুলোর নিজস্ব আওয়াজ হল যাদের জন্যে,তারা সবাই একে একে পালটে গেল।
নিজেদের বাড়িটাও।লোক কমে গেল।যারা রইল তাদের মধ্যে মনের জোর কমে গেল।পাত পড়া কমে গেল,জল খরচাও।আর সব কিছুর সাথে নিজেদের ওপর নিজেদের বিশ্বাস।মনে হল সবই যেন ঠকিয়ে নেবার নতুন চাল।আপন-পর সবেতে।দেনা পাওনা,নিন্দা-চাটুকারিতার বাইরে যেন আর কিচ্ছু নেই। ক্রমশ বাড়িটাই বিস্বাদ হয়ে গেল।বাড়ির যে মনখানা সবাই মিলে বানিয়ে তুলেছিল,তারা কোথায় হাওয়ায় উড়ে গেল।তার পর এই গলিটা। এই গলিটা কানা আজ নয়,চিরকাল।কিন্তু তারও মাধুর্য ছিল বৈ কী! বিকেল না হতে হারমোনিয়ামের আওয়াজ।গলির মোড়ে বুড়ো কাকুর তবলার রেওয়াজ আর তার ভাইপো দীপ দাদার সেতার। ঠিক তাদের উল্টোদিকের বাড়িতে টিটু কাকু সরোদে সুর বাঁধছে। এসব আওয়াজ মানেই আমাদের লক্ষী দত্ত লেন।
 এই গলিতে নানা রকম অনুষ্ঠান হত আজন্ম দেখেছি। রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা তো পেটেন্ট ছিল।এছাড়া সারাবছর লেগেই থাকত কিছু না কিছু। প্রতিবেশীরা এমনিই,কুটকচালি বাদ দিয়েও অনেক কিছু নিয়ে আলোচনা করত।কারোর বাড়িতে অকারণে যেতে সংকোচ হত না। আর ছিল পাড়াজোড়া কাঠগোলাপের গাছ।তাতে ঝেঁকে ফুল...কী ফুল কী ফুল! স্নিগ্ধ সাদার বুকের মাঝখানটা উজ্জ্বল হলুদ।তাতে সারা গা থেকে মনের ভিতর অব্দি স্নান করার মতন সতেজ গন্ধ। আজকাল পাড়ায় ঢুকলেই চটুল টিভি সিরিয়ালের গানের সাথে সাথে অভাবনীয় কিছু অপ্রাকৃত শব্দ কানে আসে।কেউ কী গান গায় না? গান শোনেও না? আগে কেমন রাত্রি বেলায় ভানু জেঠুরা হেমন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাত। ভাবুন,অন্য কেউ নয়,হেমন্ত।তাও এই রাত দশটা নাগাদ...একটা ঠান্ডা গলার আওয়াজ এবাড়ি ওবাড়ি ভাসত। আমার এখন মনে হয়,সবাই ওদের আশীর্বাদ করত ওই সময়ে ঐ গান বাজানো র জন্যে।
মোট কথা যেমন ছিল তেমন নেই।কিছুই থাকেনা জানি,তবে পাল্টেও কিছু কিছু রং পাকা থাকে।সে আশা ছিল।হুট করে চোখ তুলে একদিন দেখি সব বেভুলে হারিয়ে গেছে। আমাদের এই পাড়া,এই বকুল ফুলে ভরা ফুটপাথ।বাড়ি আসার পথে সেই বকুল বাঁচিয়ে ফেরা,যাতে পায়ের নীচে ফুল না পড়ে...।এত মায়ায় ভরা বেঁচে থাকা,এত এত সাহিত্যের মতন,গানের লাইনের মতন,সিনেমার সিনের মত দৃশ্যে ঘেরা জীবন সমস্ত কেমন অশৈল্পিক হয়ে গেল।যা হতেই পারেনা। কারণ সবের প্রকৃতি থাকে,ধাঁচ থাকে।আজ একটা বড়ো কথা বলে ফেলাই যাক,কেউ মারতে আসলে দেখা যাবে খন!  এই পাড়ায় জন্মে,এই উত্তর কোলকাতায় জন্মে আমার এবং আমাদের বোধ হয় বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন হয়েছে। এক খন্ড ভারতবর্ষের স্বাদ পাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে তাই।যেখানে সবাই,সব্বাই এক জায়গায় নিজের মনে এবং সবাই মিলে থাকে। সবাই আলাদা,কিন্তু এক পাড়ার।এক এক বাড়ির ফোড়নের এক এক রকম গন্ধ।এক এক কাকিমার এক এক রকম ডাকের সুর।তাদের বাপের বাড়িটুকু ডাক-খোঁজের সুরে পরে থাকেন রাতদিন।সেসবও তো মেশে! এখন এই যে ডাকের স্বর,সুর আলাদা করে চিনতে শেখা,তারপর মনের মধ্যে একটা বটুয়া - যাতে মনুষ্যজীব তার সামগ্রিকের ইতিহাস জমায়,শুনে,দেখে,গল্প শুনে,তীর্থে হেঁটে...সে তার ইতিহাসের পুঁতি,কান ভাঙ্গা খেলনা,পাবন মাটি,পীরের মাদুলি সবটুকু নিয়েই তার আগামীর রাস্তায় মাইলের হিসেব লেখে।কারণ পিছনের দিকটা কত দূর সে তখন খানিক হলেও জেনেছে।এই জানার নেশা বিতিকিচ্ছিরি রকমের। জানতে জানতে ,জানা জমাতে জমাতে যখন ব্যাগ উপচোয়,অথচ নতুন জানা'রা জন্মেই চলেছে,তখন হাঁ হয়ে যেতে হয়।বেমালুম হাঁ।তখন নিজের চিন্তা ভাবনাও সবার মাপের হয়...বলেছিলাম না? যৌথ পরিবার আসলে ভালোবাসা,রাগ,দুঃখের মতন একটা বোধ। বেশীর ভাগ আবেগ প্রবণ পরিবারে এই বোধ বাড়ি ছাড়িয়ে পাড়া,এলাকা,মায় দেশ অব্দি ছড়িয়ে যায়।"আমরা সবাই" বলতে পারলে যেমন ভালো লাগে,তেমন কী আর কিছুতে লাগে? এই বোধের নেশাও বড়ো মন্দ না।এই ভাবতে ভাবতে সবের ওপর ভারি নিজের নিজের বোধ জন্মায়।বলছি আমরা ভাবছি আমার...এই যা দেখছি,যে পথে চলছি,যে বকুলগুলি বাঁচিয়ে ফিরেছি আবার বাড়িতে,সেই বকুল,সেই বাড়ি আমার...এই নিবিড় ভাবের কালে পেট্রলের কাজ করে ঋতু।কাকভিজে আষাঢ় মাস।আধ খানা পড়া বইয়ের মত মনখারাপেরা  ,ঘুমিয়ে থাকে।কুন্ডুলি পাকিয়ে।যেন পোষা বেড়ালটি।
এই বাড়ি ফেরায় নতুন কিছু খুঁজছিলাম।অন্ধ যেমন সারাদিনটাই রাত্রি ভেবে হাতড়ায়।তেমন।তারপর বাড়ির দিকে চোখ পড়ল।যে বাড়িটা থেকে বাইরেটা দেখা শুরু।সুন্দর চিনতে শেখা যেই অস্বাচ্ছন্দ্যের স্বর্গরাজ্য থেকে,দুনিয়া দেখতে গিয়ে ভুলেই গেছিলাম একরকম।এত শত বাঁক।এত শত অলিন্দ,আমাদের আলয়,নিলয়।আবার সবুজে ভরে উঠেছে সিঁড়ির চারপাশ।আমাদের ভাঙা বাড়ির ইঁট বৃষ্টিতে ধুয়ে উপন্যাসের এক একখানা প্যারাগ্রাফের মতন হয়ে উঠেছে।ছাতের জলের পাইপের পাশ দিয়ে ঘন,ফলফলে সবুজ লিকপিকে ফার্ণ উঁকি মারছে।তেলাকুচর লতা এলিয়ে পড়েছে বৃষ্টির ভারে,আহা রে ন্যাকাষষ্ঠী সুন্দরী! কানে লাল টোপা দুল।দেওয়ালের গা ফুঁড়ে যে অশ্বত্থ গাছটা  বেরিয়েছে ,সে ব্যাটার এই টুকুনি লাল লাল পাতায় আর লুচিপাতায় সিমেন্টের দেওয়াল বেলোয়ারি হয়ে গেছে।আমি এত দিন বিশ্ব,সাহিত্য,ইম্পোর্টেড মুড়ির ঠোঙা,হিউম্যান টো টাকিলা ছাইপাঁশ দেখলাম,আর এই চিরকেলে দক্ষিণারঞ্জনের সেটা-আপ চোখে পড়ল না? অনুশোচনা ভোলার প্রথম ধাপ,চোখের মাপটা উত্তল লেন্সের বদলে চার আঙ্গুল ব্যাসের চুড়ির মাপে আনা।পাড়া থেকে  বাড়ি এলাম,বাড়ি থেকে চার আঙ্গুল চুড়ির মাপ। ছোড়দাদু,বাবা,মা আর আমি।এদের চারপাশে গোল্লা মার্কা।সেই প্রথম ক'টা ইঁটের গল্প। সব স্বপ্নের বাগানের মাঝে একটা না একটা জলের ব্যবস্থা থাকেই।হয় ফোয়ারা,নয় সাধ্যমতন পদ্মপুকুর।কী হয় তাতে? না বাগানের শোভা বাড়ে।উঁহু শুধু তা নয়।বাগান মানে হাজার ঘাসের প্রাণ।ঘাসেদের বাড়ি। অত ঘাসের গোড়ায় জল লাগে অনবরত।জল সেই স্নেহ। পরিবারেও এমন এক একজন জল-মানুষ,জল-মানুষী থাকে।কালে কালে সে পদে নতুন লোকের অভিষেক হয়।যার অভিষেক হয় সে বহু শখের শৌখিন হলে বুঝতে সময় লাগে।এখন বুঝতে পেরে গেলে জল সেঁচতে হয় যে! এবাড়িতে এই গোটাটার বঙ্গানুবাদ বিকেল বেলার এক খানা মন মাতানো চা! এই চায়ের কত মহিমা! বছরভর মুখ গোমড়া করা তিনজন যেন আগের জন্মের ছাতে ফিরে চায়ের কাপ হাতে।অথচ,এই ছাতের কাজ ছিল বুকে কাপড়  নিয়ে দিনরাত পোড়া,আর বুড়ো লোকের মাটি গুঁড়িয়ে সার মাটিই বানাবার ক্ষেত্র।আবার মাদুর পড়ে ছাতে।আবার মুকেশ।বাড়ি ফেরা যে হচ্ছে ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারছিলাম।চায়ের জলের মাপ আর দুধের মাপ সাংঘাতিক ব্যপার।তারপর চিনির মাপ।সঠিক চা বানাতে চা বানাতে বানাতে গোটা বারান্দা জুড়ে ছিনে জোঁকের মত মায়ের পিছনে ঘুরতে হয়,সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক গল্প বলতে বলতে।তারপর ফোন হাতে বিভোর হয়ে যেতে হয়।তারপরই তিড়িং করে লাফ মারতে হয়,কারণ ওদিকে চা উথলে যাচ্ছে। চা ছেঁকে বিস্কুটের সাথে আমার মায়ের গান শুনতে ইচ্ছে করে।শ্যামল মিত্রের। " দূর নয় বেশী দূর ঐ সাজানো সাজানো
বকুল বনের ধারে
ঐ বাঁধানো ঘাটের পাড়ে।" এই গানটা মা শুনতে চায় বিকেলে।বারবার। শুনতে শুনতে এক হাত তুলে এক জায়গায় বসে বসে,চুড়ি-শাঁখা পরা হাত ঘুরিয়ে নাচার মতন করে। আমি আর বাবা দেখি।ওই আমাদের অতিঘন আনন্দ।একটু  ভালো চা (ও সুমন,ঐ দেখো গো! ) একটু শ্যামল মিত্র...এরই ভেতর স্প্রের মতন বৃষ্টি আসে ঝমঝমিয়ে আসার আগে,আমরা ভাগের ওইটুকু মেখে নিই ঘাড়ে মুখে।আহ বাড়ি ! আমাদের বাড়ি।
ফিরেছি যে তবুও বুঝে নিতে মেনে নিতে সময় লাগছিল।সব অস্থির প্রকৃতির মানুষের এটা হয়।মেনে নিতে সমস্যা! ভালো হলেও হুড়কো হাতে ছোটে,এমন সন্দেহ বাতিক! আবার ধরা যাকে কেউ কাউকে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবেসেছে নিত্যদিন।তারপরে তার ওপর আর ভালোবাসার ওপর মহা বিরক্ত হয়ে প্রাণই ফেলে দিয়েছে আস্তাকুঁড়ে।তা সে হালার বাঙ্গাল প্রাণ তাতেও যায়না।সেই ফিরতে হয়েছে তার কাছেই।এখন ভালোবাসতে ভয় করবেনা?বিরক্তি মজার জিনিস,চেনা পেলে,মনে মনে হাঁফ ছাড়ে!কিন্তু ভয় যে কাটেনা।চারপাশের অচেনার ঘোর কাটেনা এমন মজবুত বুনোট।আমি তবে কোঠায় যাই ঠাকুর? থাকুরের ডায়নামিক্স হল সে ভদ্দরলোক কথা বলেননা। চোখে আঙ্গুল খুঁচিয়ে দেখান।যেদিন পরপর বৃষ্টির পর আমাদের ছাতের ইঁটের রং খোলতাই হল।আমি সেই হাঁ-করা মেয়ে হয়ে গেলাম আবার,আর ধুয়ে যাবে জেনেও একটু খানি সাজালাম ছাত।একটা আধখানা চকের টুকরোর মাছ।ব্রতকথার মাছ,
গেঁয়ো,এমনি মাছ।কিছুনা।কিন্তু তারপর যা দেখা গেল দেওয়াল জুড়ে,কাঁধ ঝোলা মেয়ের মাথা উঁচু হল আবার।সে তার বাবান কে বলল শুট করার জন্যে লোকেশনের দরকার হয়না।তারপর পাঁচুর দোকানের ডালমুটের গল্প হল।অ্যাাডেনিয়ামের বীজের,আর দুটো একটা নির্দোষ নিন্দে।তারপ বৃষ্টি নেমেছে ।রোজই নামছে। মাছ ধুয়ে গেছে জলে।কিন্তু বাড়ি ফেরা হয়েছে আমার।এভাবে প্রতিদিনেরর গান ফিরে পাওয়ায়,আর গাছের পাতায় জল পড়ার আওয়াজে,মায়ের আর আমার আবার অবিরাম অনর্থক আলোচনা,দুধ চা ও অম্বলের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে হাহুতাশ সভা, বাবানের সাথে খুব কায়দা করে কথা বলে বোঝাতে চাওয়া যে এখন আমি রাজনীতি বুঝি...এসব চলছেই।আর একটা আশ্চর্য ব্যপার,বাগানের ঘাসে সবুজের ফিল্টার দেওয়া মনে হচ্ছে।সে কী শুধু আষাঢ় মাসের গুন? নাই বা বলি কী করে?প্রাচীন কবির মাস, এই মাসে সবাই বাড়ি ফেরে...ঐ যে একেবারে শুরু তে বলা "যখন তুমি এলে আবার সব ভুলে" এই তুমি আমি নই কে বলল? একটা বাড়ির আমি ঠায় বসে ছিলাম,কবে বাইরের আমিটি বাড়ি ফিরব।ফিরে বলব "বাইরে যা গরম,বাড়িতে তো তেমন নেই? চা হবে নাকি?"  এই টুকুনির জন্যে।শুধু মাত্র এইটুকুনির জন্যে এতো দিন ধৈর্য ধরে বসা।বসায় যখন মন ভরছে ক্রমশ,মনে হল যারা এত কথা লিখবার গায়ের জোর,মুখের ভাষা,চোখের দেখা দিল,থুড়ি, অবতার কে ধরাধামে আনলেন যারা তাদের সাথে যা যা দেখিছি একে অপরে ভাগ করে নেব।আবার আলোচনা হবে এঁটো হাতে,আবার বই পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাব বাড়ি শুদ্ধু লোক।আবার সিনেমা দেখবে হাপুস হব বড়ঘরের মেঝেয়। এই সবের মূল হোতা যে,দে মেয়েকে গা দিয়ে তৈরী করে ছাড়েনি,'স্বান্ত্বনা' বানান ন-এ, ত- এ,  ব-এ - মাথায় গজাল মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছি তাকে নিয়ে তাই সন্ধ্যাকালীন ভ্রমণে যাই গঙ্গার পাড়ে।মা আর আমি গান গাই।গঙ্গায় মিশে যায়।কেউ শোনেনি,আমরা আপন মনে গাইছিলাম। মা হঠাৎ মা গঙ্গাকে ছুঁইয়ে আদর জানিয়ে আসতে গেল।আমি ছবি দেখছিলাম।মা আর গঙ্গা। মা গঙ্গা। কে কার ভাই? আমার মামামামই তো গঙ্গা। গঙ্গাও আবার  আমার মামমাম।কে কার ভাই?আমাদের গানগুলো সর্বত্র মিশে যায়।বাড়ি নিয়ে আসি পোড়ামাটির ফুলদানি আর হাবিজাবি,পথেই কুমোরটুলি।
"মা- গঙ্গা" :)
এখন আর ভয় করছেনা।আমিও তালে গোলে ভুলে গেছিলাম ঐ তিনটে ইঁটের কথা,যাদের ওপর গোটা পাঁচিল তৈরী হয়।আসলে ,দুটো।পুড়ে ঝামা হওয়া ইঁট। তবু অতীতে যার মাটি তাকে কে মারবে? তিন নং ব্যাক্তি তাদের জীবনের চুন সুড়কি সিমেন্ট হয়।বেঁধে রাখে।বাড়ি হয়।আমাদের বাড়িতে ফিরে এসেছি আবার...মন থেকে,আবার মনের মত ধূপের খোঁজ পড়েছে রাজবল্লভপাড়ায়,পাড়া ছাড়িয়ে দূরে।মনের মতন ফুলদানী আছেই...।
আমাদের অস্বাচ্ছন্দ্যের স্বর্গরাজ্যে,যা যা ছিলনা তার তালিকা খানিক বেড়েছে,তবে সে সবও হিসেব রাখা যাবে ক্ষন।অনেক জৈষ্ঠের পর একটি আষাঢ়ে প্রাচীন তিন মানুষের দল জেগেছে। ভয় কী আর? মাথা তুললে দেওয়ালের গায়ে শিকড় দেখা যায়,শিকড়ের নীচে শিকড়।
ওপরের টা দেখা যায়,নীচের শিকড়ের নতুন চারা,বাই থেকে বেরোবার সময় নিশ্চিন্তে তাকিয়ে দেখে একটা গাছ।দুটো গাছ।এত্তো গাছের মধ্যে একটা বনস্পতি। "বাবান আসছি" একটি প্রাচীন বেদ মন্ত্র।বাড়ি থেকে বেরবার সময় বলতে হয়। এমন তার ধ্বনি মাধুর্য,বলা তো দূর,ব্লগের শেষ লাইনে বানান করে লিখতে গেলেও আনন্দে কান্না পেয়ে যায়।


"যখন তুমি এলে আবার সব ভুলে।"


মনে রাখব।এই ফেরা মনে রাখব। 

Comments

বাদল সরকারের 'সারারাত্তির' নাটকের সেই অমোঘ সংলাপটা মনে পড়ে গেল। 'ঘর ভাসে না। ঘর ভেসে যায় না'। একজন শিকড়হীন মানুষের কাছে এই 'বাড়ি' বা 'ঘর' এর ছবি গুলো অচেনা, কিন্তু না বলতে পারা প্রেমের মত দামী। আজীবন লালন করার মত। অতি গোপনে। ভাল লাগল।
Bhromorer kouto said…
:) সময় করে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ :)
Unknown said…
This comment has been removed by the author.
Unknown said…
পুরো লেখাটা পড়লাম..মা গঙ্গার জায়গায় চোখ টলটল করছিলো.. ভালো থেকো.. আমার ভালোবাসা নিও.. <3
Unknown said…
bhari shundor lekha

Popular Posts