কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী?এ কোন সোনার গাঁও?




আমাদের এই নদীর ধারের পাড়ায় সব কিছুই গল্প-কথা।যাই বলতে শুরু করোনা কেন,তারই নাকি একটা "ওমা,জানিস না?" শুরু আছে। কি জ্বালা।আর এখানে সে গল্প বলার লোকও অনেক আছে ঠাকুরের দয়ায় কী গঙ্গার হাওয়ায়,যাকগে। আর সে গল্পের বলবার কায়দা,বিসমিল্লাহ! চায়ের দোকান না ঝাড়বাতির আলো বোঝা যায়না! কী রং রে ভাই! এই আগের কথা সমস্ত পরের লোকে শুনে যাচ্ছে চিরকাল।গঙ্গার পাড়ে পিল-ইয়ার ছোঁড়ারা গ্যাঁজা খাচ্ছে। হাওয়াও এই মরশুমে উত্তুরে।তাড় আছে,গায়ে লাগে। এক ভাঁড় চায়ে আর কদ্দূর আর ভাবনা চিন্তা এগোয়? ওপাড়ে কারা হলুদ আলো জ্বালে,ঘন হলুদ গড়িয়ে পড়েছে কালো জলে...কুজলা তলে কোন সনাতন ডোবে, ভাসে। মনুষ্যজীবন কচুরিপানা মিঞা,জোয়ারের বাড়ির ঝি। যতটা শহরের আঁতুড়,তার চেয়েও বেশি গোলগাল গৃহস্থ গ্রাম আজও আমার পাড়া। সিরিয়াল ছাপিয়ে শাঁখের ফুঁ ওঠে আজও।মুয়াজ্জিন ৫টায় আজান দেয় ৩৬৫দিন।পাঁচটা চেনা আজন্ম,ওই ডাকে।সে কী ডাক! চিরকেলে ভীতু প্রাণী,চিরকেলে অবলা প্রাণী মানুষ যেন প্রথম ডাকছে প্রকৃতিকে।মুয়াজ্জিন ভোরকে জাগান। বাগবাজারের ওইটুকুনি একটা দরগা থেকে সুর ফুঁড়ে ওঠে আকাশের দিকে,নিদ্রা নাশো,তন্দ্রা নাশো,ভোর,মধু ভোর।শীতকালে সব আওয়াজই মুখরা।একটুতেই বিরাট। মাঝে মধ্যেই ঢাকের, ঢ্যাঢাং ঢ্যাঢ্যাং আওয়াজ পাওয়া যায়। কালী পুজো হয় তো। এই সব নিয়ম মাফিক তিথি পালন কিছুতেই কিছু ভুলতে দেয়না।গায়ে গেঁথে দেয় তিথি-নক্ষত্রের বুড়োটে ব্যপার-স্যাপার। তেলে ভাজার দোকানের তেল মাখা ৬০পাওয়ারের হলদে বাল্বের নীচে কমলাটে বাদামী সোনার মোহর-ফোহর উপুড় করা থাকে আমাদের পাড়ায়।অন্তত এখানের লোকের চোখে তাই। এই সময়ে জমে ভালো, সাথে দুটাকার এক ঠোঙা মুড়ি।একটা লঙ্কা ফাউ।হুশহাশ ঝালের পর এক ভাঁড় চা।এই দ্যাখো ঘুরে-ফিরে আবার সেই গঙ্গার ধারে! গলির ভেতরে আসতে আসতে যে জানলা দিয়ে ছিটকে এসেছে সরোদ রেওয়াজের আওয়াজ।সেই জানালাটার কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে,এমনের চেয়ে আলাদা ছিল কিছু কী?গল্পে শোনা, বইতে পড়া এখানকার তখনের কথা,এখনের চেয়ে খুব আলাদা তো নয়। এই ভাবনায় ভাবনায় ঝিম লেগে আসে।নোনা লাগা গঙ্গার ধারের রেলিং এ সবুজ,ঘন সবুজ ডুমুর গাছের পাতায় হিম দোলে।জলের ওপর।মাটি রঙের জলে সবুজের ছায়া কালো মনে হয়।বাড়ির পথে আবার গলি।গলি ফুঁড়ে আরো গলি।সরুর সরু,তস্য সরু। এই গলি পেরিয়ে আসায় রোজ নিজেকে ধন্য মনে হয়,অমন  কম জায়গায় এঁটে যাবার ক্ষমতা এই বাজারেও মজা পাইয়ে দেয়।সত্যি বলছি।বাড়ি ফিরে পায়রা নিয়ে জরুরী আলোচনা হয়।পাখির সাথে মানূষের মন জুড়ে আছে কেমন আরেকবার টের পাওয়ায়।তারপর গাছের ডাল ছাঁটা নিয়ে বাপে মেয়েতে ঝামেলা হয়।জল না দেওয়া নিয়েও। মেয়ে হুব্বার মতো হ হ করে গলা উঁচু করে ঝগড়া করে।তারপর খানিক বাদে সে দুজন কে দেখা যায়,ছাতেই উবু হয়ে,টবের খুব গা ঘেঁষে বসে আবারও গাছ নিয়ে আলোচনা করতে করতে।আলোচনার বিষয় হয়ত গি্রিশ ঘোষ। একা বাড়িতে বিকেল থেকে রাত হয়ে যায় রবি শঙ্করের রাগা'স বেনারস শুনতে শুনতে।আর সে রাত তখন মুখর হয়...এই যে তার ফল। সেই এক গোলোকধাঁধার ধূপের গন্ধ আমায় ঘুরিয়ে মারে অলিতে গলিতে , নদীর ধারে,বাজারের ভেতরে যৌথ মিটারের জটপড়া তারে,চায়ের দোকানে লম্বাটে গ্লাস,কানা ভাঙ্গা।দাবা খেলছে কিছু কাঁচাপাকা মাথা,উল্টোদিকে পুঁটে ছেলে,কাঁধে ব্যাগ।আসতে যেতে গলির ভেতর বাড়ির ভেতর বিশাল মন্দির,বলদেবের আরতির শব্দ,মদনমোহনের গান...আহ! বিসমিল্লাহ বাজছে নিমতলার লঙ্গরে। কিছু ছেঁড়া ঘন কমলা গাঁদার মালা মাথার ভেতর ভেসে যাচ্ছে গঙ্গাজলে। ভিজে গামছার লাল চেককাটা আড়ালে বেড়ালের থাবা চাটা,ছায়াবাজি।ঘুঘুরা দেওয়াল ফুঁড়ে বেরোনো অশ্বত্থে বসেছে, সাবধানে।ওষুধের কৌটোয় পৌরাণিক চিঠি "পরম কল্যাণীয়া রাণু..." আমার ঘরে পাখি আর বুদ্ধ একসাথে সাজানো আছে। 

দিনের পর দিন যায়।অকর্মণ্যের সময় অফুরাণ।তাই দেখাও ফুরোয় না। গঙ্গায় শুশুকেরা মাঝে মাঝে মাথা তুলেই নামিয়ে নেয়। যেন উত্তর কোলকাতার অতীত। 


Comments

Popular Posts