আবেগজনিত...

শরৎকাল বাড়ি আসার কাল-এই এক লাইন দিয়ে যে কতবার কত লেখা লিখতে চেয়েছি।হয়ে উঠেছে,ওঠেনি...আজও শেষ অব্দি কী হবে জানিনা।তবে বলা চাইই! না হলে মুক্তি নেই। ১৫নং লক্ষ্মী দত্ত লেন,বাগবাজারের একটা এইটুকুনি জায়গা।যেখানে থাকাটা রীতিমতো লড়াই এর বিষয় হয়ে উঠেছে বাড়ির প্রতিটি সদস্যের।তাতে নিখিল বিশ্বের কিছুই যাওয়া আসা উচিত নয়,কারণ সাধারণত তাইই হয়।আর এমনিতেও বিশ্ব নিয়ে এই বাড়িরও কিছু যায় আসেনা।ফলে ল্যাটা চুকে গেলো।কিন্তু আবেগ বড়ো কঠিন জিনিস।আরো কঠিন বিস্ময় বোধ।যার বিস্ময় যত বেশী তাঁর ঝুঁকিও তত,এ তো জানা কথা।কিন্তু এমন বহু কিছুর আকরও এই পথেই যে পাওয়া!চক্রবর্তী বাড়ি বাংলাদেশ ছেড়ে এই বাড়িতে এসে ওথেন।বামাচরণ চক্রবর্তী ও সুনীতি চক্রবর্তী।আমার বাবার ঠাকুর্দা এবং ঠাকুর্মা।যদিও বাবান এরা সব্বাই নিজের ঠাম্মা কে 'মা' আর দাদান কে 'বাবু' মানে 'বাবা' বলে ডাকত।ওদের বাবা কাকাদের দেখাদেখি।হি হি।আর নিজের মাবাবাকে বলত বাবা আর বৌমা।আমার বড়োকাকু তার নিজের মাকে কাকিমা বলে,দাদা-দিদির শুনে...আমাদের যা কিছু হোকনা হোক এই ডাক নিয়েই কিন্তু গল্প চলতে পারে...সে দিকে যাবোনা।উপন্যাস হয়ে যাবে।আজ এই সকাল বেলায় আমি যখন টাইপ করছি তেড়ে,তখন আমার পাশে সানাই বাজছে।রাগ দুর্গা।বিসমিল্লাহ!! এই ১৫ নং লক্ষ্মী দত্ত লেনে আজ অনেক শরত পরে এমন রোদ উঠেছে।আজ আবার বোধ হয় ফিরে পাবার দিন...। 
আসলে এই বাড়ির কাছে  ঋণ স্বীকার করা হয়নি কখনও।কখনই।আমার মা'কে বহুদিন অব্দি জানানোই হয়নি আমি মা'কে বেশ অনেকটা ভালোবাসি।খুনোখুনি মতন।তেমন।এই বাড়িটার পরিবেশ ও রক্তজনিত যাবতীয় কিছু অমনিই পেয়ে গিয়ে কত না কী সাপের পাঁচ পা,ইয়ে করতে পারেনা বন্দুক ঘাড়ে...।অথচ শব্দে কখনো বলা হয়নি,শুধু এই বাড়িটায় ।এই ভোগলিক অবস্থান্টুকুতে আছি,তাই আজকে,,এইমাত্রও একবার খুব আনন্দ হলো।অসম্ভব আবেগপ্রবণতার আনন্দ...এবছর অনেককাল পরে বর্ষার পরে এমন শরত এসেছে।এমন হাওয়া...এমন মেঘ।আমাদের বাড়ি দক্ষিণ খোলা।চারটে ঘর।পুরোনো সংসারে ঘর বলতে যেমন ছিল,তেমনি।হ্যাঁ,ঠিক তেমনি এই ২০১৬ তেও।একটুখানিক রদবদল,কিন্তু সেও সামান্যই।এখনও আমামদের জাফরি,ঘুলঘুলি,কুলুঙ্গি আর তাতে আমার ছোটবেলাকার ঝুল ইন্ট্যাক্ট।বাড়ির জানালাগুলোর বয়স নাকি ৪০ বছরেরও বেশি! ভাবা যায়! কতদিনের সব।সবাই বলে,আগে নাকি এই দোতলার ওপরে গঙ্গা জলের কল ছিল! রান্না ঘরের কোণায়। অমনিই জল উঠত চাপে!সেসব অবশ্য বাবার ছোটবেলার কথা...আর আছে কড়িকাঠের ভেতর খুপরি তাক।কী যে মজার।যদিও তেমন মজার জিনিস তাতে রাখা হতনা...এবাড়িতে একই সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস,কমিউনিস্ট আর নকশাল বাস করেছে।ওসব গোপন খুপরি কোনও ব্যপারই না।আর এমনিও বোধ হয় তখনের দিনে গেরস্ত বাড়িতেও অমন স্টাইলই চালু ছিল কড়িকাঠে।কত কী রাখতে লাগেনা?বড়ো সংসার।ছেলে পুলের ঘর।খাটের নীচে কাঁসা-পিতলের বাসন।কোণের ঘরের জানলা দিয়ে গৌরীমাতা উদ্যান,আর এই হাওয়া...এ বড়ো পারিবারিক।খালি মনে হয় সবাই বাড়ি ফিরুক,বাড়ি আসুক প্রিয়জনদের কাছে এই সময়ে।এই প্রাচীন শহরের আরো প্রাচীন যে অংশটার অনাবিস্কৃত খনি আগলে আমি বসে আছি,তা আমিও দিয়ে যাই কাউকে।কিন্তু আমার পরে এবাড়িতে বুকুন।বুকুনের পর নেই।আমার ছোট বোন সেই বাড়িটা দেখেনি যে বাড়িতে আমি জন্মেছি।ও জানেনা শিবরাত্রির দিন গঙ্গার ঘাট যাবার গলিটায় ঢোকার উত্তেজনাটা কেমন...ওর জানার অবস্থাও ছিলনা।আমি জানতাম।গলিটায় ঢুকলেই একটা মাটির পুতুল কেনা যাবে।গঙ্গার ধারের  কাছে বাড়ি হলে  ক্যালেন্ডার লাগেনা।তিথি-টিথি ওসব অমনিই জানা। ুদযাপনের এমন ধুম সারাবচ্ছর,অমনিই টের পাইয়ে দেবে খন 

বোধহয় এক পাড়া চাঁদ উঠেছিল।থ্যাঙ্কফুলি লোডশেডিং ছিল।আমরা সপরিবারে ছাদে বিছানা করে শুয়ে আছি।ছাদ পেরোলে মাঠ।গৌরীমাতা উদ্যান।ধুয়ে যাচ্ছে জোছনায়।মাঠ পেরোলে বড়ো রাস্তা।ভূপেন বোস  এভেন্যু। গাড়ির আলোগুলো পুরোনো জোনাকির মত কাছে এসে মিলিয়ে যাচ্ছে।আমাদের চিনে যুঁই তে  ফুল হয়েছে।ইঁটে প্ল্যাস্টার নেই।তাতে কী? বাকি ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। রেডিও মাথার কাছে নিয়ে শুয়েছিলাম আমরা। অত চাঁদে কারোর ঘুম আসছিল না,গল্প করছিলাম...এমন  সময় গান হল " অলির কথা শুনে বকুল হাসে" আগে বলেছি এই গল্প? ওহ মা গো! সে যে কী আশ্চর্য পাওয়া আমাদের সব্বার...সব্বাই কেঁদে ফেলার মতন ভাব! সেও কিন্তু এই বাড়িতেই। 

এমন তো প্রায়ই হয় যে অসম্ভব সব সম্ভাবনা তৈরী হয়...কিন্ত আদপেই বাস্তবে তা হয়না।সে ক্ষেত্রে অগতির গতি বাড়ি ও একটু ভালো চা।আর জীবনে মানুষ কত কম চাইতে পারে?! এমনিও সে ধ্রুব আর নেই...তবু চা আসে।"ফাইন লিকার" এর যে চাইনিজ মানে নকল প্রচেষ্টাটি সারাজীবন ধরে করে আসা হয়েছে,সেটি আরো একবার করা হয় ও  কালকের চেয়ে বেটার নাহ ইত্যাদি আজেবাজে কথা বলা হয়।কিন্ত ওইযে চা টুকু,ঐ যে ওর ভেতর ছোটবেলার তিনটে -পাঁচটা-আটটা গল্প,ঐ যে কাবারিওয়ালার থেকে উবু হয়ে বসে কেনা ল্যাম্পশেড ,ওর  এইটুকুনি নিজের মতন আলো,-তাতে যে ঐ "আমাদের বাড়ি" মনে হওয়াটা...গলা ব্যথা করায়।খুউব।

আমাদের নেই রাজ্যের রাজপ্রাসাদে,যে কোনোও উৎসব প্রথম আসে  বিছানার চাদরে।উজ্জ্বল রঙের চাদর ,যাতে আলো চলকে ওঠে সবার গায়ে।আর পর্দা।সেও একই নিয়ম।গানের কথা বলার কী আছে? তবু আরো একটা জিনিস আছে।রোগা কাঠি ডিগডিগে...নরম সবুজ একটা তিরতিরে গাছ।জানালা ঘেঁষে।আমাদের সংসারের ঐ একটি মায়াবি চাহিদা...এ বাড়ির দেওয়ালে ফুল ফোটে,আমি বাইরে কী আর সাধে বেরোতে চাইনা?

গতবছর মহালয়ার দিনের আগের দিন থেকেই মনের মধ্যে একটা প্রবল ইচ্ছে হয়েছিল,যে গঙ্গার পাড়ে বসে   বছরের এতোগুলো দিন কাটে,তার পাশে  এ'ও না হয় হোক। কিন্ত সে যে কী  মহা আয়োজন! ভেবেছিলাম কানে হেডফোন লাগিয়ে এই চেনা গলিগুলোর গায়ে ঐ গমগমে গলাটা ঐ গান গুলো বুলোতে বুলোতে চলে যাবো...রাস্তায় বেরিয়ে  দেখি প্রতিটি বাড়িতে একসাথে মহালয়া চলছে রেডিও-তে।একটা ঘোর পুরনো কোলকাতার আদিম ভোরে আমার  সাথে চলেছে শক্তি  পুজো করতে! কেমন যেন! এই বাড়িটায় থাকতে পেয়েছি বলে এগুলো হয়! ছাতের পাঁচিলে ঝুঁকে পড়ে দেখা যায় মাঠে প্যান্ডেলে কে কে এসেছে...অন্তত আজ অব্দি যাচ্ছে।

সামনের বাড়িটায় কন্ট্রাক্টর হাত দিয়েছে।জানিনা এই জানালা দিয়ে বসে আমাদের মাঠের নাগোরদোলনার ছায়া আর দেখা যাবে কিনা। আদৌ এই পুরোনো প্রাচীন পাড়াটায় এমন কোনও বাড়ি থাকবে কিনা জানিইনা।শুধু লিখে রাখব বলে অতীতের দিকে তাকানো,বর্তমানে সেই মিলিয়েই বিস্ময়ে ঘুরে বেড়ানো আর দুমুঠোয় অকুলান কিছু দুর্মূল্য স্মৃতির বোঝা নিয়ে এগিয়ে চলা ভবিষ্যতের ভাঁড়ারের দিকে।
১৫ নং লক্ষী দত্ত লেন,আর কিছু দিক না দিক,অবাক হবার আনন্দ পেতে শিখিয়েছে।তাই আজও ভ্রমি বিস্ময়ে ভ্রমি বিস্ময়ে...

Comments

Bhaktacharyya said…
অসীম কালের যে হিল্লোলে জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে ..নাড়ীতে মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,...বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান!
Unknown said…
এই লেখাটাও বেশ। এককালে প্রায়ই বিকেলে মায়ের ঘাটে বসে সন্ধ্যে হওয়া দেখতাম। ১২-১৩ বছর আগের কথা। সেসব মনে পড়ে গেলো। আর আজকের মতো শরৎকালের সকালও অনেকদিন বাদে দেখলাম, ৬ বছর বাদে এই সময়টায় কলকাতায়।
Kanishka said…
চালিয়ে যা ... বেশ হচ্ছে।

Popular Posts