আগমনী

পুজোর আর দিন পনেরো বাকি।চারদিকে যে সাজো সাজো রব,সে আর কাউকে বলতে হবেনা।শোভাবাজার মেট্রো হয়ে যে রাস্তাটা রাজবল্লভপাড়ার দিকে এসেছে সেটা ছাতিম-টাতিমে একসা হয়ে...চারপাশে সাজগোজের ধুম! বাড়ি বাড়ি খালি প্যাকেটের খড়মড়ানি।নতুন নতুন পলিথিন প্যাকেটের মূল্য ১৫ নং লক্ষ্মী দত্ত লেনের বাড়িতে চিরকালই কাঞ্চন তুল্য।মা এই প্যাকেটপ্রাপ্তির উত্তেজনায় প্রায়ই ভুল করে ফেলেছে।ছোটো তাড়াতাড়ি বাড়িফিরে আসছে তারপর আদা-এলাচ দিয়ে দুধ চা,আর নতুন কেনা ব্লুটুথ স্পিকারে জগন্ময় মিত্র।বড়ো সেদিন এসেছিলো,মিস হয়ে গেলো গানটা।এ বাড়ির মেজাজ সুরে বাঁধা।পুজো আসছে তাই খেতে বসার আগে কিশোরের বাংলা গান চলছে।বাবান খেতে বসে একটা পা তুলে রেখে।আমাদের মাটিতে বসে খাওয়া হয় তো,তা বাবা বসে হাতে তাল দেয় পায়ের পাতার ওপর "আকাশ কেন ডাকে..." মায়ের ব্যপার অন্য।তার শ্যামল "দূর নয় বেশী দূর ওই..." খেতে বসে বাঁ হাতটা নাচিয়ে নাচিয়ে ...ছোটো আর  আমি রোজ একবার করে ওগো কাজল নয়না হরিণী দেখে এবাড়ির সনাতন প্রথা একে অপর কে ধাক্কা মেরে "ওওফ উত্তম!! গুরুউউউ! মরে যাবো শালা! " এইসব বলে মারা যাচ্ছি।হ্যাঁ,অলমোস্ট রোজই।যাকগে যা বলছিলাম,মায়ের ভুল হবার আরেক কারণও আছে।সে কারণ আবার ব্লগ লেখে।আ মরণ দশা! মায়ের সেই কারণের বয়েস ২৬ বছর।তার বয়েসী প্রতিটি মেয়ে যেখানে চাকরী ইত্যাদি করে পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেছে,সে সেখানে উবুঝুঁটি বেঁধে নিতান্তই আহ্লাদীপনা করে চলেছে।যদিও আমার মুখের ফিলোসফিক্যাল কথা শুনে দূ-উ-র থেকে তা বোঝার উপায় নেই।কিন্তু সবেতে তো গায়ের জোয়ারী চলেনা! এখন পুজো আসছে! কার কী করবার করে নিক !
আমাদের পাড়ার বিকেলগুলো আমার ছোটোবেলা থেকেই বোধ হয় এক রকম রঙের,এক রকম শব্দের।দুপুরের হলুদ থেকে বিকেলের নীল হয়ে যায় দেখতে দেখতেই।আজ থেকে  নাকি দিনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে...কফির জল ফুটে উঠল,আমি যাই...
লক্ষ্মী দত্ত লেনে শাঁখ  বাজে সন্ধ্যে হলে।রোগা ডিগডিগে তুলসী গাছ জল পায়।প্রদীপ জ্বলে।আর বাগবাজারে নিবেদিতা পার্কের পাশের মাজারের আজান শোনা যায়।বাড়ি গুলোর নিজস্বতা যেন ঐ একের গায়ে এক লেগে থাকাতেই...এই যে গোল গোল ঘুর্ণি দেওয়া বারান্দার শিকের ডিজাইন,তার ভিতর দিয়ে এসে পড়া ছায়া দেখতে দেখতে ঘন ঠাস নীল জামদানী সন্ধ্যা।হ্যাঁ,এই জাতীয় হলে সন্ধ্যা বলতে হয়।কি জমকালো! সবকটাই।কী বাড়ি ,কী বাড়ির এক্সটেনশন,পাড়াটা। আলোর মালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে রাস্তার দিকের সব কটা বাড়ির গায়ে। বড়ো বড়ো ডুমো ডুমো হলুদ বাল্ব। সেকেলে? কিন্ত ঐতেই যে উৎসব চেনার হাতেখড়ি! কী আর করা...
সেদিন বিকেলে এককোটি বছর বাদে ছাতে উঠেছিলাম।মরকুটে কয়েকটা গাছ দেখি আজও বেঁচে আছে! কোন লজ্জায় বুঝিনা।একটা বড়ো প্রিয় বোগেনভিলিয়া ছিলো।মরে গেছে সে।ঈকেবারে।আর জল দিলেও বাঁচবেনা।তারই মরা ডগায় দেখি কমলা রঙের ফড়িং! আমি তো চমকে...! আমি তো ছোটোবেলায়...আমি তো কিশোরভারতী...!কী যে অপূর্ব তার রঙ,রূপটি না ধরে রাখলে হয়না।ফড়িং এসেছে মানেই তো মাঠে শুধু বাঁশ দিয়ে বানানো তৈরী প্যান্ডেল।জোড়গুলো লাল-নীল ফিতের মত কাপড়ের টুকড়ো বাঁধা।এই সময় রাজবল্লভপাড়ার 'স্যায়না'-রা বেরোয়। কমিটি মিটিং এ ডিমের ঝোল আর কোয়ার্টার পাঁউরুটি খাওয়ার ফলে টপসিড খেতে হয়।চাঁদার বইয়ের কাউন্টার হারিয়ে যাওয়ায় "মুকে লাতি মারব শোর" ইত্যাদি শোনা যায়।এসব মানে জ্বলন্ত সিগন্যাল,আসছে আসছে।এর মাঝে মাঝে কয়েকটা বিরাট আলোচনা হচ্ছে,পুজোয় বৃষ্টি ভাসাবে?পুজোয় সিপিএম ফিরবে? এক কাপ চা তিনটে ভাঁড়ে,এই দিকে...
শুধু একটি দরজা বন্ধ।সে দরজার পিছনে দজ্জাল।তার বরের টাকা বারো ভুতে খেলো।দুজনে ভিকিরি হলো।একসাথে যতক্ষন কাক-চিল বসতে পেল না,ডাক্তার-বদ্যি ছুটে এলো।আলাদা হলো যেই, অমনি...তবু দুজনের তেজ কমেনা।কেউই কাছে আসেনা।এদিকে তেজ দেখানোর বহর চলছেই...ভাদ্র মাসে বাদলা করে দেয়,আশ্বিন অব্দি...চলছে তো চলছেই।অসবর্ণ বিবাহে নাকি ঝগড়া হবেই।মায়ের তাই মত ছিল না।তাতে ঐ রকম চণ্ডালে হাবভাব। তবে দজ্জাল ভেবে ছিলো তাকে চণ্ডালই সামলাতে পারবে ।এই কনভিকশনে এসে দেখে ওরে ভবের ঠাট! আজ কাতলা মাছের ঝোল,কাল নন্দীর মনখারাপ এই অজুহাতে বাপের বাড়ি আর যেতেই দেয়না! দজ্জাল তাই দাপিয়ে ফুঁসে কেঁদে-কেটে একসা।বর এটা ফিবছর সয়ে নির্লিপ্ত।তাই 'seen 12 hrs ago' আর শেষ কথা 'hmmm'
অবশেষে দজ্জাল ঠিক করেছে এই মাসের শেষেই আসবে। যা খুশি হোক গে যাক, তিনি নিতে এলেই নাক চ্যাপ্টা পাহাড়ের মেয়ে গলে জল।আবার কী?!
কেউ কেউ বাপের বাড়িতে আসেই তাকে কেউ আদর করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসবে বলে।আসলে দুতরফের আদর কাড়ার ছল।এটা সেই সেইই থেকেই চলছে। 


Comments

Popular Posts