আনুবউ

                            এই যে 'নেই-নেই',অভাবী জীবন,ভাগ্যিস এমনটাই এখনও আছে।আমার বিয়ের গয়না বানাতে দেবার মত অবিশ্বাস্য এবং অহেতুক ঘটনা এখানে ঘটেনা। এই বাড়িতে রেডিও'র নাটকে শোনা গান, ৫০ বছর আগেকার গান ফিরে পেলে,তুমুল হৈ হল্লা,আলোচনা হয়। বাড়ির মেয়ে হুমড়ি খেয়ে Youtube এ গান খুঁজে মরে,বা শম্ভু মিত্র।নীলমণিলতা। মানে,এমনিতে,আপাতদৃষ্টিতে,কোনই মানে হয়না এসবের।সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের আর সময় আরো একটু বেশি বাঁচিয়ে ফেলার EMI দিতে দিতে  এমনিতেই তো বা-আ-আ-জুবন্ধ খুলুখুলু যায়! তবে?উপায়? সেসব ধরুন জানিনা। গরীবের যে রোগ হয়,তার নাম ঘোড়ারোগ।আজকের দিনে,ইন দিস সেঞ্চুরি।কেউ বিশ্বাস করবে?শুধুমাত্র দামের মধ্যে ভীমসেন যোশীর সিডি পাওয়া যাচ্ছেনা বলে দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে টেনশনে শহরে দৌড়ে বেড়াত? আবার শেষমেশ অগতির গতি শ্যামবাজার চশমাগলির থেকে পাওয়া গেল,কিন্তু যশরাজ। আজ অব্দি মন খারাপ।শুদ্ধু দাম।হ্যাঁ! শুধু দামের জন্যে ভীমসেনের বদলে যশরাজ! ঠিক হ্যায় বেটা! নেতাজীহ! তুমকো ভি ঈয়াদ রাখেঙ্গে!
কিন্তু ভাগ্যিস নেইটা আছে! নেই নেই করতে করতে থাকার অভ্যেসটা চলে যায় তো! একসময় 'নেই'-টার সাথেই প্রকৃত বন্ধুত্ব হয়ে যায়।এমনিই,কখনও মনে হয় 'নেই'-টা বেশি ভালো।কী জানি...হবেও বা। কিন্তু আমার ভালো বলার উদ্দ্যেশ্য দুটো।
প্রথমত,
৬ বছর আগে, আমি এক খানা কবিতাও বেমালুম হারিয়ে ফেলেছিলাম।সময়মত ধরতে না পেরে। দুয়ের সাথেই পুনর্মিলন বোধ হয় এই বছরেই শিডিউলড ছিল।আমার এই প্রাপ্তি যোগ আদপে টেঁকে কিনা তা নিয়ে কারই বা কি বলার আছে? কিন্তু কবিতা প্রাপ্তি সম্পর্কে আমার আলবাৎ কিছু বলার আছে। একটা অদ্ভূত মানসিকতার কথা তার আগে বলা প্রয়োজন।যে বাড়িটায় বড়ো হয়েছি,সে বাড়ির লোকগুলোর বুকের মধ্যেকার জিনিসপত্তর আর তাদের পরিবারদত্ত মেধার প্রমাণ,কয়েকটা ডিগ্রীর কাগজ। এই সব ছাড়া সম্পদের ধারণা তৈরী হয়নি। আর বাকি অন্যান্য জাগতিক সবকিছু নিয়ে বাড়ির লোকও কেউ ভাবিত ছিলোনা,আমিও নই। তাই ছেড়ে আসাটা জলভাত হয়ে গেছে।  মা বলে অতি ভোগীর ত্যাগ সহজ। আমি বলি, যে পায়ইনি,সে ছাড়তে ভয় পাবে কোন দুঃখে?
এর কারণ শুধুমাত্র নিম্নমধ্যবিত্তের অহংকার,তা নয়। সব কিছুই বুঝে ফেলতে যখন প্রথম থেকেই খুব কম সময় লাগে,তখন চলার গতি থামিয়ে লাভ কী বাপু? তাই আমি চির কাল, চিরটা কা আ ল চলার পথে সব দেখতে দেখতে,ব্যাগে ভরতে ভরতে গেছি।থমকাইনি কোথাও? নিশ্চয়ই! সেগুলোই তো রোমন্থনের খাদ্য! ছ'বছর আগে,আচমকা,সেই বইমেলাতেই,যুবশক্তির স্টলে-এ দেখা।জয়দেব বসু।কবিতায় চটপট চোখ বুলিয়ে, মনে মনে নাম মুখস্থ করছি,হুট করে একটা শব্দ গেঁথে গেলো। "আনুবউ" । আমার as usual তাড়া ছিল।চলে এসেছিলাম।কিন্তু আনুবউ...আমি ছ'টা বছর পাগল হয়ে ঘুরেছি! কত বই পেয়েছি,ওনারই। পড়িনি। অদ্ভূত গোঁয়ার্তুমি।ঐটাই চাই।অথচ নাম জানিনা।যাদের জিজ্ঞাসা করি তারা তাঁর নামই জানেনা,তায় কবিতা,তার আবার লাইন...ওহ! আসলে চাহিদা নেই তো! কোনই চাহিদা সেভাবে কোনও দিন তৈরীই হয়নি। শাড়ির লোভ আছে, নিজের মনের মতন মানুষটার ও,আর মনের মতন একটা বাড়ির...এই সব কিছু বাদে আমার নিজের একেবারে নিজের চাহিদা বলতে গান,প্রকৃতি আর সাহিত্য...নইলে কারোর অমন প্রবল কষ্ট হয় ভীমসেনের বদলে যশরাজ বাছতে?
এর আগেও এমন হয়েছে।চকিতে শোনা গান।তাই নিয়ে তোলপাড়। অবশেষে বাংলাদেশের হৃদয় হতে বেড়োলেন অর্ণব। কপাল পোড়ার দুঃখের গল্পটা অন্যদিন একদিন লিখব। এই 'আনুবউ' থুড়ি 'ভ্রমণকাহিনী'-ও তেমন।একটু বেশি বিশেষ,তার কারণ...তার কারণ, পূর্বমেঘ। উত্তরমেঘে পুনঃপ্রাপ্তির রং এমন লাগবে কে জানত?আমার বন্ধু, সম্বিত বসু,ওকে কে না চেনে? ক্ষুরধার বদ।কিন্তু ওর মতন থমকিয়ে দেওয়া গদ্য- tough...quite tough!  কিন্তু তাই বলে ওর বদামো কমে যায় না! নেহাত আমি কুট্টিকে খুবই স্নেহ করি,তাই একান্তি যে সম্বিত ফেলে মারার আমার ইচ্ছে,সেটা আর লিখলাম না।প্রিতিটি মানুষের জীবনেই সম্বিতের মতন সুহৃদ বন্ধু থাকে।যে সময় মতো,নিজের অজান্তেই কিছু লেখা পাঠায়,যা, "কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে", "আগুন নেভাতে পেট্রোল" প্রভৃতি ভূমিকা নেয়। এ কাজ ও অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে বেশ কিছু কাল যাবত করে আসছে। এসব সত্ত্বেও, মানে দূর থেকে, এমনিতে ছেলে তো ভালো! আমি যখন ফেসবুকে মাথা কুটে মরলাম আনুবউ খুঁজে, ও সমগ্র ধরে দিলো।PDF-এ কাঙ্খিত বই পাবার মজা এই প্রথম টের পেলাম। বইটা চেয়ে ঐ অপেক্ষা করা, তারপর ওয়ালে ভেসে ওঠা থাম্বনেল,কেঁপেই গেলাম! শুভদৃষ্টি হচ্ছে...আনুবউ...দেখতে পাবো? বইটা ডাউনলোডে দিলাম। আমাদের বাড়ির ওয়াই ফাই স্পিড নিয়েও একটা লেখা লিখব একদিন...যাকগে।শেষ অব্দি হল! বই নিয়ে বসে আছে।ফাইল খুলতেও জড়তা! তারপর কী ভেবে,দৌরে গিয়ে স্নান খাওয়া সেরে নিয়ে বসলাম। ফাইল খুলল। স্ক্রিন জুড়ে সাদা পাতায় বই এর নাম লেখা। কী অনন্ত প্রশান্তি,তবু তার মধ্যেই তিরতির করছে ভয়। সমগ্র-র পাশে প্রথম খন্ড লেখা আছে তো! সব যদি আমার হবে,তবে তার আবার খন্ড কেন?? যদি না থাকে? পাতা বেয়ে নামছি। দুটো বড়ো সাদা পাতা যেন ডুব দেবার পরের আলো,মাথা তুলতেই দেখলাম সাদা কালো স্পষ্ট সূচীপত্র। নেই।ঐ নাম বা নামের আভাসওয়ালা কবিতার নাম,কিচ্ছু নেই। তবুও...কী যে হল...ও আলোর পথযাত্রী? কী জানি...আরো খুঁজতে খুঁজতে আবারো নামি পাতা ধরে,দেখি 'ভ্রমণকাহিনী'। ঈশ্বর! আয়রনির অবধি না রেখে এত্তো দিন পর, এই এত্তো দিনের শেষে,দেখা হল আনুবউ এর সাথে! এই  মহিলার মুখটুকুনি দেখতে চেয়ে কত বাড়ির কড়া নাড়া! কত দোরে দোরে ঘোরাঘুরি! বৃথা যেত? নাম কবিতা। 'ভ্রমণকাহিনী'। আমার কষ্ট হয়েছে বলে কোলকাতায় মিছিমিছি বর্শাকাল,আমি যেন ছেলেমানুষ বুঝিনা! বন্ধুর হাতে এসেছে দরকারী বই। আমার কাজে অকাজে দিনরাত কাটছে দিব্যি। আর,

দ্বিতীয়ত,
"চলতে চলতে ইঁয়ুহি কোই মিল গ্যয়া থা" পাকিজার এই গানটাও আমার ভারি প্রিয়।এটাও ভুলে গেছিলাম।আজ মনে পড়ে ভালো লেগেছে।ঐ আর কি,তুমি ছাড়া কে আর জানবে বলো? "সরে রাহ...চলতে চলতে"। তোমার সঙ্গে তো আর কথা নেই। এখন ভালো আছো তো?

Comments

Popular Posts