Once upon a November in ঘাটশিলা

অতঃপর আবারও পশ্চিম। বহুদিন না বেড়িয়ে, ক্ষেপে গিয়ে চলে আসা।মানুষ বেড়াতে আসে বা যায় বাড়ির অভ্যাস বদল করতে,তাই নয়? কিন্তু আমাদের তিনজনের ক্ষেত্রে এ নিয়ম খাটেনা।যেখানেই যাইনা কেন ,আমাদের বাড়ি লাগে একটা।আর সে বাড়ি বানাতে খুব একটা জায়গাও লাগেনা,হোটেলের একটা ঘর হলেই যথেষ্ট হয়। তাই  এই তিনজনের কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় পরিযায়ী চলনে। স্টেশনে নীল ট্রেন থামে,সেকেন্ড ক্লাস থেকে দুনিয়ার লটবহর নিয়ে নামে তিনজন।   সে হোক গে যাকগে তিনদিনের বেড়ানো,খালি হাতে তো আসা যায়না। স্টেশনের বাইরে আসে তিনটে মন।তিন রকম। চোখ কিনতে থাকে একের পর এক দৃশ্য।প্রথমেই বাজার,তারপর চায়ের দোকান, বিড়িটা,সিগারেটটা; গলি চৌমাথা, এ.টি.এম। তারপর ঘর পছন্দ করা।অল্প বাজেট,একটু বারান্দা...?ব্যস! ওতেই ঢের! তারপর যা হয়,ব্যাগ খুলতেই অজ পাড়া গাঁয়ে ঘর বাঁধে স্বামী-স্ত্রী ও মেয়ে। কোনও প্রস্তুতি নেই বলেই মনে হয়,কিন্তু ঐ খানেই ধোঁকা ! মনীষা চক্রবর্তীর হাত ব্যাগ বিষয়টা হেলাফেলার নয়,মোটেও নয়! ঐ ব্যাগে যে কী আছে আর কী নেই সে কথা পষ্ট করে বলা যায়না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস  মায়ের ব্যাগ খুঁজলে মোক্ষও পাওয়া যাবে! মানে যেতেই পারে আর কী! ছুঁচ-সুতো,তেল-নুন,হাতা-খুন্তি,রেলের টাইমটেবল,হাতা-হাতুড়ি,মাফলার,সাপের বিষ নামানোর ওষুধ কী যে নেই! সেসব একে একে বেরিয়ে আসে ব্যাগ থেকে। গুছিয়ে তোলা হয় পরিযায়ী সংসার। বাবা লোকাল বাজারটা ঘুরে আসে। মাছ-টাছ...মাছের ডিমের বড়াটা! এছাড়া ভুলে যাওয়া টুকিটাকি। ট্রেসমে শ্যাম্পুর পাতা, মাঝারি লাল টিপ, জিলেট রেজর,মশা ধুপ।কিনতে গিয়ে বাবা বন্ধু পাতায়।বেড়ানো বৃক্ষের কত যে পাতা! যদিও প্রাথমিক আলাপের সূত্র আঞ্চলিক রাজনীতির অবস্থা কেমন,এখানে কী কেউ গণশক্তি পড়ে ইত্যাদি। এর পর কোটি-কোটি,হাজার-হাজার কথা।ওদিকে মা তখন হোটেলের ঘরে ঝ্যাঁটা নেই কেন,সেই শোকে স্তব্ধ।মেঝেতে নাকি  পা রাখাই যাচ্ছেনা।কিন্তু আশ্চর্য ভাবে মা ছাড়া সেটা কেউ ফিল করছেনা,তবুও।এছাড়া আমি কী কি আনতে ভুলে গেছি ,সেসব নিয়েও একটা চাপা শোক আছে। তাই মা বিছানা থেকে উঠে বারান্দার দরজা খোলে।বাইরে কোলকাতার বাইরের স্বাভাবিক সবুজ দেখে মায়ের মন ভালো হয়ে যায়। মা তখন গুনগুন করে গান গায়। তেমন গান কোলকাতায় মেঘলা দিন এলে শুধুমাত্র শুনতে পাওয়া যায়।ভালোলাগা আর মন কেমন মেশানো সুর,কথা নেই। বাবা ফিরে আসে নতুন পাড়ায় "বাম্পার একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেছে" সেই খবরটা নিয়ে। ব্যস চাহিদা তো এইটুকুই।সুতরাং লাফাতে লাফাতে তিনজনে মিলে চা খেতে যাওয়া।সেখানে বসে বিশ্ব-সংসার নিয়ে তিনজনের আলাপ,সংলাপ,আলোচনা,সম্মতি,বৈষম্য।তারপর একে অন্যের হাত পেঁচিয়ে অচেনা রাস্তা সাবধানে পার হয়ে দিনকয়েকের "বাড়ি"-তে ফেরা। ফিরে এসে অদ্ভূত আনন্দ হয় অন্তত আমার।বাড়িতে আজকাল আমাদের তিনজনের সারাদিন শুধু অকারণে খাটে বসে গল্প হয়না...সময় মেলে না মোটেও।এই বেড়াতে এলেই একমাত্র সেটা হয়।খাটে বসাটা গুরুত্বপূর্ণ এখানে।আমাদের মাঝারি বিত্তের সবচেয়ে বড়ো চিহ্ন এই খাট।যার সাধারণ ব্যবহার হওয়া উচিত ছিল শুধুমাত্র শোবার জন্যে,তা আমাদের বাড়িতে চিরকাল অতিথি কে বসতে দেওয়া,বই রাখা,ইস্তিরির বেস,আরো নানা দরকারী কাজে ব্যবহার করা হয়ে এসেছে,চিরকাল। আমি নিশ্চিত এমন আজো অনেকের বাড়িতেই হয়,এটা বলতে এখনও বেদম অদ্ভুত লাগলেও বলছি ,তার কারণ অনেক বাড়িতেই তার চল নেই।খাট যে সার্বজনীন ধারক,কলি-র নোয়ার নাও তা অনেকেই জানেন।মানে খাটেই জীবন যাকে বলে।তেমনি বসে জানলা দিয়ে নতুন বাইরেটা দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে আসে। অল্প অল্প খিদে পায় তিনজনের।আবার গুটি গুটি সদ্যচেনা চায়ের দোকানে।বাবা ঠিক ততক্ষণে দোকানীর 'কাকু'।সন্ধানে সেই দোকানেই মেলে সিঙ্গাড়া,চাটনী দেওয়া,উহ! দুকাপ করে চা খেয়ে ফেলি তিনজনেই! হ্যাপিনেস,ইয়ু নো!
ঘাটশিলা এলেই বিভুতিভুষণ এর কথা আসে।ঘটনাচক্রে এবারে যেখানে থাকা,সেটা ওঁর বাড়ি থেকে হাঁটাপথ। ঐ বাড়ির ঠিক উল্টোদিকেই বেশ বড়ো একটা কুঁয়ো।তাতে আবার একটা ছোট্ট একটা কচ্ছপ।হলুদ সবুজ পিঠ।আর কিছু মাছ।রুপোলি,চিকচিকে পিঠ।নিজের মনে ঘুরছে ফিরছে।পারে বসে চ্যাংড়া ছোঁড়ারা খুব আড্ডা মারছে।কী চুলের বাহার! মুখগুলোতে ওপর-চালাকির প্রলেপটা নেই মোটেও।বরং স্পষ্ট ভাবে অচেনা মানুষদেখার স্বাভাবিকত্বটা আছে। রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা টিলার ওপর আমাদের বাড়িটা। ওপরে মানে সত্যিই ওপরে,আক্ষরিক অর্থেই। টিলা কেটে কেটে বাড়ি বানানো।বানিয়েছিলেন হিমালয়ের  মুক্তেশ্বর মহারাজের দাদা। মুক্তেশ্বর মহারাজ নিজেও এই বাড়িতে থেকে গেছেন। অদ্ভূত ধরণের বাড়ি একটা।তৈরী হয়েছিল মূলতঃ একান্তে ধ্যান ও সাধনা উপলক্ষ্যে। প্রায় এক বিঘা পরিমান জায়গা নিয়ে তৈরী একটি বাড়ি।সামনের অংশটি একটি প্রকান্ড হল। তা ব্যাডমিন্টন কোর্ট হিসাবেও আরামসে ব্যবহার করা যায়। হলের শেষে দোতলা বাড়ি।পাকা বাড়িই।বাড়ির এক তলায় বেশ কটা ঘর। সেখানে থাকেন স্থানীয় স্কুল কলেজে পড়তে আসা ছাত্ররা,আর চাকুরীজীবি কিছু মানুষ। মুক্তেশ্বর মহারাজের মৃত্যুর পরে ঐ বিশাল জায়গাটিকে রক্ষা করাই আপাতত তাঁর পরিবারের লোকেদের চিন্তার বিষয়। কেয়ারটেকার বাবু, ঐ আশ্রমেই ছোট থেকে বড়ো হয়েছে।তার পরিবার পাশেই থাকে।তার মতন ছোট বয়েসের একটি ছেলের একার দায়িত্বে অমন বিশাল একটা জায়গার দায়িত্ব দিয়ে কেই বা  শান্তিতে থাকতে পারে?গভীর রাত অব্দি এই সব গল্প শুনতে শুনতে কখন  খাবার ঠান্ডা হিম হয়ে গেছে জানতেও পারেনি তিন গল্প খোর। এমনি ভাবেই দিন দুয়েক।চেনা চায়ের দোকান,মনোহারী দোকানে "এই একটু ওদিকে "-র আলাপ। পশ্চিমের আবহাওয়া কোলকাতার চেয়ে বেশ ঠান্ডাই।এ সময়ের শাল বা চাদরে একটা অভিভাবকত্ব থাকে। গায়ে জড়ালে ভরসা ভাব জাগে একটা।ওহ,এই অঞ্চলের এমনিতে বেজায় সুখ্যাতি এখানকার জলের জন্যে।ন্যাচুরাল মিনারেল ওয়াটার কিনা। সেই কারণেই আসে-পাশে ওষধি গাছের ছড়াছড়ি! বিশেষ করে হাতা,জাদুগোরা,মুসাবনী অঞ্চলের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা দূর-দূরান্তে বিখ্যাত।বহু মানুষ আসেন এখানে ওষুধ সংগ্রহ করতে,বা ডাক্তার দেখাতে। কী রুখু জায়গা।লালচে মাটি। একটু পরে পরেই টিলা।গায়ে ঘন সবুজ গাছ।এখানে সবাই বাংলা বলে,কিন্তু সেই সুরের বাংলায় আজ বাঙলাদেশে কেউ কথা বলেনা। আড় বাঁশির শব্দের মতন এই জায়গার প্রকৃতি। ধার যেন নতুন কাস্তে।দিনের রোদের ধার। রাতে শীতের।বুকের ভেতর অব্দি জ্বালিয়ে দেয়।আবার চোখও টানে।প্রচুর খনিজ থাকার কারণেই এই মাটিতে অসংখ্য বনফুল ফোটে।চেনা দিশি আগাছা-ফুল।কিন্তু মাটির গুণে তার এমন বাহার ,যে বলার কথা নয়।আর দেখনার মতন প্রাচুর্য অ্যান্টিগোনাস লতার।ক্ষুদে ক্ষুদে উজ্জ্বল গোলাপি লতা হয় বেয়ে বেয়ে উঠেছে বিশাল গাছের মাথায়,নয়ত পুরোনো বাড়ির ভাঙ্গা পাঁচিল থেকে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে...।কোথায় যে নেই!চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল।গুঁড়ি গুঁড়ি ফুল মাটিতে ঘাসের মধ্যে। লাল,নীল,হলুদ,বেগুনী...মাটিতে পা রাখতে মায়া লাগে।এই হল সব জায়গাটুকুর সার। মায়া। রুখা-শুখার ভেতর সবুজ বিনবিনিয়ে উঠেছে লাল ইঁটের পাঁচিলে।পাশেই এই এতোখানি চোখ, সাদা গরু। খুব নিশ্চিন্ত লাগে।মানে কেমন একটা না?যেমন বিভুতিভুষণ দেখিয়েছেন বারবার।ঝোপে,বনে-জঙ্গলে,কুঁড়ে ঘরের উঠোনে দাঁড়িয়ে তারা দেখে ভেসে গিয়ে,তারা দেখে বিহবল হয়ে তিন জনে কত কথা এভাবেই ঘুরপাক দিয়ে বলে ফেলে,ভেবে ফেলে।ভেবে যা ফেলে তা বাইরের লোকে জানতে পায়না।তবে একে অন্যে জানতে পারে...২৬ বছরের সঙ্গত কিনা! সাতপাঁচে রাত গাঢ় হয়।নতুন বিছানায় ব্যথা গায়ে ঘুম। সে ঘুমের দাম হয়না। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে, আনকা জায়গায় ঘুম।
তাকিয়ে দেখি সোনালি মাঠ,কুঁড়ে ঘর,কারা যেন গরু তাড়িয়ে নিয়ে বেড়চ্ছে কাজে।আমি আজন্ম শহরে থাকি।তবু যে বাড়িতে বা যে অঞ্চলে থাকি,সেখানে আজও গ্রাম ঘরের বহু পালা-পার্বণ পালন হয়ে থাকে। সারা কোলকাতার লোক যখন ছট পুজো নিয়ে অতিষ্ঠ,তখন এই পশ্চিমের ছোট্ট শহরে সুবর্ণরেখার পাড়ে অস্ত সূর্যের সামনে  হাজার হাজার লোকের নীরব,সনিষ্ঠ, সনাতন পুজো পদ্ধতি স্মৃতি হয়ে রইল।ফিরতি পথে হাট।সারা সপ্তাহের মশলা,ঝুড়ি-দড়ি...ঠুনকো গয়নার চোখটানা। শহুরে মেম এক নিমেষে হাঁ করা গেঁয়ো মেয়ে।বিকেল আরো বাড়লে মন কেমন করে,খুব...বাড়ি ফিরবার জন্যে।সত্যিকারের বাড়ির জন্যে।হয়ত এক নদী অন্য নদীর কথা মনে করায়।ব্যক্তিগত বায়াসডনেস থাকলে এসব ক্ষেত্রে যে ধরণের হিংসুটে অনুভূতি হয় আর কী! সাজিয়ে যাকে বলতে হয় "হোম সিকনেস"।আসলে বাইরে এসে যা যা পাওয়া,তা তো বাড়িতে পাইনা! কিন্তু বাড়িতেই তো ওসব পেতে চাই। তাই যেই দু-একটা কুচি বা টুকরো নাগালের মধ্যে পাই,ফিরতে ইচ্ছে করে।যেখানে আমার পরিসরে একটা গাছ আমার জঙ্গলের স্মৃতি।কিছু মলাটের মধ্যে কিছু ছাপা পাতা,যা আমাদের না বেড়ানোর দিন গুলোর সলতে।আমাদের এবড়ো-খেবড়ো খাটের ওপর ব্লক প্রিন্টের চাদরের কোনাটার জন্যে মন কেমন করে। টুথ ব্রাশ তুলে নেওয়া হয় ব্যাগে,যদিও হেডফোনটা ফেলেই আসা হয় শেষমেশ। সে যাকগে,রাজবল্লভপাড়ায় ঢুকে পড়লে,সব পাওয়া যাবে। এসবেই শেষ হল তিন গেছোদাদার দ্বিতীয়বার ঘাটশিলা ভ্রমণ।আপাতত সংসার ভাঁজ করে রাখা রইল বেড়াতে যাবার ব্যাগের সামনের খোপে।চেন টানা। দেখা যাক,এর পর আবার কবে কোথায় বেদের তাঁবু পড়ে। 

Comments

Popular Posts