বাজারের গল্প আর রেডিও




সব সময়ই সব বাজারের সাথে বা পাশে একটা করে চায়ের দোকান বা অমন কিছু থাকেই।এ আমি বরাবর দেখেছি। সর্বত্র।উত্তরের দিকে এমনিই আড্ডার ছড়াছড়ি। তার ওপর এই চায়ের দোকানগুলো যেন তারকা সমাবেশ। কিন্ত আপনি যদি তারা চেনায় অক্ষম হন বা তারামন্ডল যাবার রাস্তা না জানেন?? আসুন, নিয়ে যাই।চা খাবেন?
প্রাচীন শহরের প্রাচীনতম অঞ্চলগুলির মধ্যে সময় খুব ধীরে বয়। পাশের নদী বোধ হয় সে দায় নিয়েছে। তাই নদীতীরে এখনও মানুষ দু-দন্ড কথা বলে,চা খায়...বিশেষতঃ গঙ্গা পাড়ের শহরগুলোতে সর্বত্রই আমি অন্তত একই চিত্র দেখেছি। পৃথিবীর যখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই,তখন আমার নিজের পাড়ায় রাত এগারোটা অব্দি চায়ের দোকান খোলা,তার কারণ জনা পনেরো মানুষ তখনও দাবা খেলছেন।তাদের প্রাণের দাবা কুটির-এ।এই যদি রাত হয়,তবে দিনের বেলা কেমন তেজ তা নিশ্চয়ই খানিক খানিক বোঝা যায়...তবু বোঝা কী আর যায়? পুরোনো বাজারের পেটের ভিতরে চায়ের দোকান। উল্টোদিকে এইয়া বড়ো বড়ো বন্ধ দরোজা।মাটি থেকে উঁচুতে। তার চৌকাঠের কাছে কাঠের বেঞ্চ।সেও যে কী পুরোনো কী বলব।পেরেকগুলোও যেন কাঠ হয়ে গেছে এতদিনে। পিছনের ঐ দরজা বন্ধ থাকে চিরকাল।ভেতর থাকে। যা নিয়ম।ভেতর না থাকলে তো বাইরে তৈরী হয়না। ঐ বেঞ্চে বসে আড্ডা। সকালে।বাজার ফেরতা। চায়ের সাথে মাঝে মধ্যে ডিম টোস্ট।বাবা এই একটা জিনিসের সাথে মোটেই compromise করতে পারেনা। কেউই কী পারেন খুব একটা?! এই আড্ডার মূল সুর সম-সংস্কৃতি। বয়েসের তফাৎ এখানে কেউ খুব একটা মানেননা।কী যে অসম অথচ কী অসম্ভব প্রাণোচ্ছল! এই আড্ডার সাথে আমার পরিচয় করানোর জন্যে দায়ী আমার বাবা।
প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব উত্তরাধিকার সেই অঞ্চলের বয়স্ক মানুষগুলি।এই মানুষগুলির অভিজ্ঞতার দাম এর মূল্য নির্ধারণ করার কথা তো বাদই দিলাম,এঁদের যে অফুরন্ত গল্পের ভাঁড়ার তাও অমূল্য। আমার বাবার বয়স এখন ৬১। আমার গোটা দিন রাস্তায়ও বেরোতে হবেনা যদি বাবা সারাদিন বাড়ি থাকে। নেহাত তিনি নব্য যুবক,তাই থাকেন না...যাকগে।যা বলছিলাম,এখন,এই যে চায়ের দোকান ,এতে কী পাওয়া যায়? না, মাটির ভাঁড়ে চা। ঘুগনী। পাঁউরুটি।ডিমের অমলেট।ডিম টোস্ট।আজকাল অবিশ্যি কিছু কিছু দোকানে ম্যাগি করে দেয়।আগে ম্যাগিটা ছিল না। আজে বাজে দেখতে নাইলনের বাজারের ব্যাগ থেকে পার্টনারশিপে কেনা ইলিশটা পিছনের সেই বন্ধ দরোজার এত্তো বড়ো কড়ায় ঝুলিয়ে রেখে, হাঁটুতে চাপড় মেরে এর পর কী নিয়ে কথা হয়না সেটা বলুন! সে গল্প আমি শুনি বাবা বাড়ি ফিরলে। প্রায়ই ভাবতাম যাবো,কিন্ত সকাল ও আমার পারিবারিক শত্রুতা  থাকায় তা কোনও কালে হয়নি।
আজ যখন আমি আর বাবা সন্ধে বেলায়  আমার খুব পছন্দের একটা কাজ করছিলাম।হেঁটে হেঁটে নিজের পাড়ার আশ্চর্য আর অদ্ভুত গলিগুলো চিনে বেড়ানো। আমার দাদান মানে ঠাকুরদা এই কাজে আমার হাতে খড়ি করান। এখন বাবান আর আমি ঘুরে বেড়াই। আজও তেমনি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পাড়ার দোকানে চা খেয়ে হাঁটতে হাঁঁটতে গেলাম গঙ্গার ধারে। জল কেমন বেড়েছে সেই সব গল্প করতে করতে হেঁটে আবার বাগবাজার বাজার। অমনি বাবা বলল আরেকবার চা খাবো,তুই খাবি? এই জাতীয় বেহুদা প্রশ্নের উত্তর হয়? বাবা আর আমি দুটো চা 'অর্ডার' দিয়ে বসলাম। আমি ২৬ বছরে এই প্রথম এখানে।ঢুকে মনে হল,জোব চার্ণক সুতানুটিতে এসে এই বাজারে ঢুকেই বলেছিলেন "দাদা চা দেবেন এখানে একটা! সেই বেঞ্চে বসলাম আমি বাবার সাথে।বাবার পাশেই অশীতিপর এক বৃদ্ধ মানুষ
 বাবা দেখলাম ওনার পাশে গিয়েই বসল। ভদ্রলোক এতই বুড়ো হয়েছেন যে প্রায় কোলকুঁজো হয়ে গেছেন।কিন্ত এমন চমৎকার পাঞ্জাবী পড়েছেন গরদের আর তার বোতামের ঘরের  চারপাশে এমন সুন্দর কাজ যে কী বলব! দেখলাম উনি আমাদের দেখছেন।বাবা ওনাকে দেখিয়ে বলল, ইনি একজন বিশাল তবলিয়া। বিখ্যাত সব শিল্পীদের সাথে বাজিয়েছেন।তারপর দেখি ওনার সাথে ফিরে গল্প করতে লেগে গেছে! চায়ের দোকান আসলে বাজারের সদর গোড়ায়। দোকান পেড়িয়ে বাজারে ঢুকতে হয়। দুটো ১০০ ওয়াটের হলুদ বাল্ব আর যত্ন করে করা দুধ চায়ের গন্ধের মধ্যে হঠাৎ শুনতে পেলাম কিশোর কুমার নিয়ে আলোচনা করছেন দুজন। পরে শুনলাম একজন উকিল একজন ব্যবসায়ী।দুজনেই বাবার চেয়ে বড়ো।কাজের শেষে পাড়ায় আড্ডা মারছেন। গুনগুন করে গাইছেন কিশোরের গান।মুহুর্তে একটা এলাকার মানুষের আবেগের মাপকাঠিটা পরিস্কার হয়ে গেল আমার কাছে।
সাধারণত এই জাতীয় দোকানে একটা করে রেডিও থাকে।থাকেই more or less। এই দোকানে নেই বোধহয়। থাকলেও আজ যখন গেছিলাম চলছিল না। তবে গানের আলোচনাই গানের স্থান পূরন করে দিচ্ছিলো।
 বারবার এই সুপ্রাচীন চায়ের দোকানের সামগ্রিক আমেজ,অন্তত আমাকে খুব নাড়া দিচ্ছিল।কিন্ত সব ভালো জিনিসের তো একটা শেষ আছে, তাই চা শেষে বাড়ি আসতে হত। এখন, বাজার তো আর একটু খানি নয়।টানা একটা পথের দুধারে সব সাজানো; যে সময়ে আমরা ফিরে আসছিলাম তখন সান্ধ্যকালীন বাজার বসার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। রাতের খরিদ্দার বাবুরা হালকা ফতুয়া আর পাজামা পরে, বাজে নাইলনের ব্যগ হাতে,সুস্থিরে বাজারে আসতে শুরু করেছেন।প্রচন্ড বরফ দেওয়া ইলিশের পাশে গলদা চিংড়ি। উল্টোদিকে কুমড়োর ফালি,থানকুনি,কচুর লতি।আলো জ্বলেনি তখনও।সবে প্লাস্টিক টাঙ্গানো হচ্ছে।যা বিষ্টি!! বাপরে বউ নাচানে না আরো কিছু! এই আছে এই নেই! এই সব সাত পাঁচ আলোচনা সেরে আমি আর বাবা বাড়ি ফিরছিলাম।তখনও কী একটা তাত্ত্বিক আলোচনাই হচ্ছিল, ফট করে হঠাৎ বাজারেরই কোনও দোকান থেকে রেডিও tune করার আওয়াজের পরেই সামান্য জোরে,অমনি আস্তে একটা "লা লা লা লা" শুনতে পেলাম।চেনা গান,সে যত দূরেই হোক,আর যত চিলতে মতন হোকনা কেন, ঠিক ধরা দেয়। আর রেডিও...সতীন রে! চিরকালের সতীন! মা বলে "সতীন মলে মেয়ে হয়!" ,আমি বলছি,আজ সত্যি বলছি সতীন মলে রেডিও হয়। চিরকাল যখন যে গানে হু হু করে মরব সে গান সে শোনাবেই।
আজ আমরা যখন বাজারের দিকে পিঠ করে ফিরছিলাম, কিশোর কুমার তখনও দুরে,তবু কাছেই, ধীরে অথচ স্পষ্ট গাইছেন "তেরে বিনা ভি ক্যায়া জিনা?"
বলেছিলাম না প্রাচীন শহরে সময় বাজারে এলে চা না খেয়ে যায় না!

Comments

Popular Posts