পুজো ২০১৫

অনেক দিন আগে লেখা থামিয়েছিলাম। মাঝে একেবারে সময় হয়নি বললে ডাহা মিথ্যে হবে। আসলে এসব লেখার ঋতু আছে। মন কেমনের ঋতু। ধুসর শীতে এসব লেখা উড়ে আসে। স্মৃতির লেখা কিনা।
আমার নতুন কোনও গল্প মনে পড়েনি। আমি সেই পুরোনো কাসুন্দিই ঘাঁটব। ঠাম্মার যে দেরাজ খোলার জন্যে হন্যে হয়ে বসেছিলাম সেই দেরাজ খোলা হল ঠাম্মা মারা যাবার একবছর পরে। তাও হত না,যদিনা উই পোকার উপদ্রব হত। বারণ করবার যে আসল লোক সেই তো নেই...তবু কি অভ্যাসের গুণ,দেরাজে চাবি পরিয়ে টানার আগে সে যে কি একটা হল বুকের মধ্যে। শ্রীমতি অঞ্জলি চক্রবর্তীর দেরাজ। চক্রবর্তী পরিবারের বরো বৌ,একছত্র অধিকারিণী।ঢাকার প্রফুল্ল চৌধুরীর বড় মেয়ে, চৌধুরী বংশের বড়ো মেয়ে...তার নাকি দেরাজ,বুক কাঁপবে না? দিলাম টান। অমনি...যেন গল্পের বই।কলেজ স্ট্রীট এ আমাদের কলেজের গায়ে যে দোকান গুলো তাতে যেম্ন পাওয়া যায়...যে গল্পটা পড়তে চেয়েছিলাম সেটাই,শুধু আগে কেউ পড়ে নিয়েছে,তাই একটু পুরোনো।কিন্তু আমি যেই নিয়ে এলাম আমার। ঠিক তেমন লাগল। আমার ঠাম্মার দেরাজ ঠাসাঠাসি ভরা ছিল। সোনা দানার মতন তুচ্ছ জিনিসে এই বাড়ি কোনও দিনই মাথা ঘামায় নি। আমার ঠাম্মার দেরাজ এ যা যা পাওয়া গেছিল-
                    ১। দুনিয়ায় যত গয়নার দোকানের ছোট্ট পুঁটলি ব্যাগ। তার ভেতরে আরেকটা ব্যাগ।সেই ব্যাগ এ হয়ত                            দুটো আধুলি রাখা।চেন টানা।
 
                    ২। কাকা,পিসিদের বিয়েতে পাওয়া গয়নার খালি কেস বা বাক্স। নানা রঙের আর আকারের। আমার                              আবছা মনে পরে,হামলে পরে ওগুলো নিয়ে নিতে চাইতাম ছোটবেলায়।

                   ৩।রাশি রাশি সেফটি পিন। যা একদা সেফটিপিন ছিল,একথা হলপ করে বলা যায়। কোন দুর্দিনের কথা                          ভেবে রাখা খোদায় মালুম!

                   ৪।মিষ্টির দোকানের প্লাস্টিক। এক কোটি মত।

                   ৫।কানের দুলের পিছনে লাগানোর 'গুজি' ও অসংখ্য ইরেজার (রবার!)। ঠাম্মার কানের দুলের গর্তটা                             বড্ডো কাটা ছিল।

                   এছাড়া আমার অন্নপ্রাশনে পাওয়া পাউদার কেস ও পাফ, চামচে(স্টিলের), টিপের পাতা, প্রচুর দশ আর কুড়ি পয়সা। কয়েকটা ল্যাপ্স হয়ে যাওয়া এল।আই।সি-র নোটিশ। কিছু ব্যাঙ্ক- এর রসিদ। ২০০টাকা জমা হল।
দাদানের নাটক-এর দলের হিসেবের খাতা,অ্যল্মিনিয়ামের চুড়ি,কানের দুল,ইমিটেশন গলার বিছে হার,রং নেই...টিপ বোতাম,ফিতে, পুতুলের এক পাটি জুতো,বাবার ছাতার হাতল। আমি হাঁ করে দেখছিলাম।একেবারে ছোটবেলার মতন। একটা মানুষ তার ৬০ বছরের টানা সংসার জীবনে নিজের জিনিস বলতে এইগুলি জমিয়েছিলেন? কোথায় গেল বাগবাজারের চক্রবর্তী বাড়ি, কোথায় ঢাকার চৌধুরী,আমার ঠাম্মা শুধু মেয়ে হয়ে সামনে এলো আমার। আর ঠিক তক্ষুণি খেয়াল হল সংসারে বা পরিবারে মানুষগুলি যেমন প্রয়োজনীয়,তাদের প্রইয়োজন মেটাবার হদিশও তেমনি।
টিপ বোতাম ও বড্ডো দরকারী,দেরাজে রাখার মতন দরকারী।

এখন এই স্মৃতি রোমন্থনের সাথে লেখার শিরোনামের সম্পর্ক কি? সম্পর্ক হল এই যে, বিশেষ কারণে বাড়িতে বেশ টানা কদিন থাকতে হচ্ছে। এখন বাড়িতে লোক বলতে মাত্র ৫ জন। ছোদ্দাদু,বাবা,ছোট, মা আর আমি। সবাই বেড়িয়ে গেলে বাড়ি শুনশান।আমি আর মা।আর ঝিকু। আমি বেশির ভাগ দিনই ঘুম থেকে উঠে গান শুনি। তার পর মা আসে স্কুল থেকে,আমি তখনও খাইনি শুনে বকে।বকেই এক কাঁড়ি সেদ্ধ সব্জি নিয়ে নানা ডিজাইনের গল্প দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। তারপর একটু চা। তারপর এক অবিশ্রান্ত লড়াই।কিন্তু এর মাঝেও পুজো-টুজো আসে তো রে বাবা! আমার বড়ো,পিসিমণি,বুয়া এরা একসাথে আসা মানেই তো পুজো!  বড়ো আসলেই তো বড়োঘরে গমগম করে "তোমাকে চাই"! খানিক বাদেই আবার "চলো যাই চলে যাই" সে যে কিসব বোঝাতে পারিনা,চোখে জল এসে যায় মা গ! ফাটল ধরা লাল মেঝে তে আমার বাবা,বড়ো আর ছোটো খেতে বসেছে, হাতের ভাত শুকিয়ে গেছে,গল্প ফুরোয় নি।ন্যাতাটাও সামনে রাখা...এসব মানেই আমাদের পুজো। ১৫,লক্ষী দত্ত লেনের পুজো। পিসিমণী আসত অষ্টমীর দিন দুপুরে।পুজো দিয়েই। মুন্নি ,আমার চেয়ে দেড়মাসের ছোট আমার বোন,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। সারা রাত্তির ধরে সে কি আগডুম বাগডুম গল্প। দুজনেরই ছুল ঝ্যাঁটা -ছাঁট।কিন্তু মনমে আনন্দ থা! নাগোর দোল্লায় ওঠার কি ধুম!পিসিমণি আমাদের তিনজনকে ,পিঙ্কি দিদি,মুন্নি আর আমাকে টাকা দিত বেড়িয়ে কিছু মিছু খাবার।সব্বাই দিত।আর আমরা খালি লাল লাল সিরাপ দেওয়া ভেলপুরী খেতাম। তার পর এই সব কেলোর কীর্তির পর আসত বুয়া...আমার বুয়া আমার সব চাইতে ছোট পিসি। ও ঠিক আমার কে আমি বলতে পারব না।পারবই না। বুয়া পুজোয় আসা মানে সারা রাত্তির! মা আমি আর বুয়া,pnpc থেকে গান, উপন্যাস, থিয়েটার,নতুন লেখা, কবিতা, মনস্তত্ব,স্মৃতি রোমন্থন ...আরো না জানি কি। একদল খাটে শুয়ে।একদল মাটিতে।কেউ গভীর রাতে নিন্দের উত্তেজনা সহ্য না করতে পেরে পাপোসের ওপর উঠে বসে আছে...।এমন সময় শুধু,খুব ক্ষীন অথচ দৃঢ় স্বরে ঠাম্মার গলা পাওয়া যেত "তোরা ঘুমোবিনা রে...?" সামান্য জিজ্ঞাসা অথচ পড়ি কি মরি করে শুতে যাবার হিড়িক পড়ত। এখন মাত্র পাঁচ জন। বড়ো ছাড়া এবারও বোধ হয় কেউ আসতে পারবেনা।
গত কাল রাত্তির অব্দি প্ল্যান হয়েছে আজ সারা বাড়ি ঝাড়পোঁছ হবে। আমি শুয়ে শুয়ে ইন্সট্রাকশন দেবার মহান কর্তব্যে নিযুক্ত আছি বলে মনে মনে হিসেব করছিলাম কি কি ফেলে দেবার আছে।মানে একেবারে ত্যাগ!চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে এমাথা ঝিম ঝিম করল হঠা্ত। আমার মা, শ্রীমতি মনীষা চক্রবর্তী দেব্যা।তাঁর জন্ম ,বৃদ্ধি,প্রগতি,বিপ্লব ও কর্ম ( পরে বলব ক্ষন!) এই বাগবাজারের রাজবল্লভ পাড়ায়। কিন্তু তিনি আর পাঁচজনের থেকে এই খানেই আলাদা কারণ সংসার বস্তুটির বিষয়ে তিনি least bothered.দেশে  প্রকাশিত হওয়া ধারাবাহিকের কথোপকথন মুখস্থ বলে যাওয়া আমার মা,থিয়েটার করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পাওয়া আমার মা, চিরকাল চাকরী করা,বাইরে বাইরে থাকা আমার মা সেই এক সম্পদ জমিয়েছে বিভিন্ন দিকে। সেই প্লাস্টিক।সেই  কাগজ,সেই ব্যাগ...কিছু বললেই বলেন "একদিন কাজে লাগবে এই ভেবেই তো রাখা,আর কি,ফেলে দে..."।আমি অবাক হয়ে আছি আজ খুব। তাই তড়িঘড়ি লিখতে বসলাম। আমাদের মেয়েদের জীবনের পথ কিন্তু প্রাথমিক অবস্থা থেকেই খুব সুচিন্তিত। সব কাজের অভিজ্ঞতা আমাদের আলাদা রকম হয়। একটা সামান্য ভারী বাক্স একটি মেয়ে তুললেই তাকে বাহবা দেওয়া হয় আলাদা ভাবে।তার কারণ সে মেয়ে,দূর্বল হওয়াটা তার স্বাভাবিক প্রকৃতি। কিন্তু এই ধরনের যাবতীয় মিথ মেয়েদের কাছেও যে খানিকটা মিথ সে আমার নিজের চোখে দেখা। আমার ঠাম্মা,ভালো ঠাম্মা, মা,বড়োপিসি,ছোড়দিদা,পিসিমণি,বুয়া এদের দেখে,এদের জীবন চর্যার সামঞ্জস্য দেখে বারবার মনে আধুনিকতার একটা খুব স্বচ্ছ ধারণা তৈরী হয়েছে। আর হ্যাঁ,মেয়ে হয়েছি বলে ভীষণ গর্ব হয়েছে। এই মেয়েলি যাপনের পথে কত কী তো আসে,বিবাহিত অবিবাহিত সক্কলেই আশা করি তা স্বীকার করেন,কিন্তু এর মাঝে আঁচলের আড়ালে বোধ হয় সব মেয়েদেরই একটা করে দেরাজ থাকে?সেই খাতাঞ্চির খাতায় পুতুর সবুজ বইয়ের মতন? অফিসের ঝুল কালি কাদা, একান্নবর্তী পরিবারের প্রতিটি সদস্যের  যত্ন নেবার পরেও মেয়েদের বুঝি একটা আলাদা সংসার থাকে...সেই সংসারে সে বেশ অন্নপূর্ণা! যে যা চাইবে তাই বেশ পাবে।তেলে হলুদে,ঘামে চুল চেপ্টে আছে।সে দুহাতে ব্রহ্মান্ড  নিয়ে বসে আছে। তার। ভরা ভর্তি সংসার! একটা সেফটিপিনও বাড়ন্ত নয়!আর তাই দেরাজে ভর্তি থাকে মেয়েলিপনা। সোনার চেয়ে ভরিতে,দামে দেড়া !
আরেক মেয়ের আসার আর দু তিন দিন বাকি। সবাই পুজো আনন্দে কাটান। শারদীয়া শুভেচ্ছা।

Comments

tani said…
Darun GAGAN.. Get well soon...
RIK_KHEYALI said…
aji chole jachhi baire..pujor bhromon! eto bochhorer jibone,ei prothom pujoye ghor chhara.. bhalo lagchhilo na ghum theke uthe.. ghum theke uthei lekha ta pore fellam. ei je porlam.. bhablam.. bhalo laglo.. onyo rokom bhalo laga. asa kora jaye pujo tao onyo rokom bhalo katbe.. bhalo katuk onyo moto; asha rakhi. Subhechha.
Unknown said…
যে আটপৌরে পুজো গুলো প্রতিদিন আমাদের ঘরকন্যায় আখর সাজায়, তার ছবি আঁকতে চেয়ে যতটা আটপৌরে হাওয়ার কথা ছিল তা হতে পারিনে... ঘর ছেড়ে বাস সাজানোর যত্নে তাই ঘরের পুজো গুল বড্ডও দূর হয়ে যায়... আপনার লেখায় কাছে এল আনেকটা... অনেক ধন্যবাদ !!!
আরও পড়ার ইচ্ছে রইল... :)
Bhromorer kouto said…
#RIK_KHEYAL keman holo berano ??

Popular Posts